
লেখক, সাংবাদিক উর্মি রহমান প্রাণের বাংলার জন্য লিখছেন দূরের হাওয়া বিভাগে জীবনস্মৃতি; ‘মনে পড়ে’। তার শৈশব, কৈশোর জীবনের বয়ে চলা পথের গল্পগুলো এই ধারাবাহিক জুড়ে থাকব। উর্মি রহমান দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করেছেন। কাজ করেছেন বিবিসি বাংলা বিভাগেও। এখন বসবাস করেন কলকাতায়।
আমরা যতই ভাবি, জীবনটা এভাবেই চলুক না, ক্ষতি কি! কিন্তু বাস্তবে সেটা হয় না। অন্ততঃ আমার জীবনে সেটা ঘটেনি। জীবনে বার বার পরিবর্তন এসেছে। আমার বিবিসির কন্ট্রাক্ট শেষ হলো, যদিও আমি একই ভাবে ক্যাজুয়াল প্রযোজক হিসেবে কাজ করতে থাকলাম। সাধারনতঃ ক্যাজুয়াল প্রযোজকদের সন্ধ্যায়/রাতে এবং সপ্তাহান্তে কাজ দেয়। আমি অন্য একটা চাকরি খুঁজতে লাগলাম। আমার অন্য সহকর্মীরাও সেটা করেছেন। একটু সময় লাগলেও কাজ পেলাম প্রথম টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের একটি দফতরে। কাজটা ছিলো অনুবাদকের। আমাদের সঙ্গে বিবিসিতে অনুষ্ঠানে অংশ নিতো শ্যামল সেনগুপ্ত, সে সেখানে থাকায় এই কাজটার খবর পাই। শ্যামল আসলে চলচ্চিত্র জগতের মানুষ, ছবি বানিয়েছে। সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইন্সটিটিউটের ডীন হয়েছিলো পরে এবং প্রচুর ভাল ভাল ছবির স্ক্রিপ্ট লিখেছে। সেখানে বছরখানেক কাজ করার পর আর একটি কাউন্সিল, লন্ডন বারা অব নিউহ্যাম’এ কাজ পেলাম।
কাজ প্রায় একই ছিলো। পরে ক্রমে কাজের ধরণ খানিকটা পাল্টায়, দায়িত্বও। সেখানে প্রায় ২০ বছর চাকরি করি এবং ল্যাঙ্গুয়েজ প্রজেক্ট অফিসার হিসেবে সময়ের আগেই অবসর গ্রহণ করি। তবে সেসব পরের কথা। এই সময় আমি গাড়ি চালানো শিখি এবং ড্রাইভিং পাশ করি।
এখানে একটা কথা বলি, বিলেতে কিন্তু ড্রাইভিং পাশ করা খুব সহজ নয়। আমাদের এক আত্মীয়, যিনি সরকারের বড় বড় পদে ছিলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রীও হন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তিনি তাঁর কন্যার কাছে স্বীকার করেছিলেন, তিনি জীবনে একমাত্র একটি পরীক্ষায় একবার ফেল করেন, সেটি হলো লন্ডনে ড্রাইভিং পরীক্ষায়। গাড়ি চালানো শুরু করার পর ইংল্যান্ডে প্রচুর ঘুরেছি আমরা। অনেক মনোরম ও ব্যতিক্রমী জায়গায় ঘুরেছি। দীর্ঘ পথ একা ড্রাইভ করে পাড়ি দিয়েছি। তার কারণ বিলেতে সবাই ট্রাফিক আইন মেনে চলে আর রাস্তাও খুব ভাল। এবার নিউহ্যারেম আমাদের বিভাগের কাজ সম্পর্কে কিছু কথা বলি। লন্ডনে বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের বাস, যাকে বলা যায় অত্যন্ত ডাইভার্স শহর।বিলেতের অন্য অনেক শহরও তাই, কোনোটা কম, কোনোটা বেশী।
লন্ডন শহর বিভিন্ন বারা কাউন্সিলে বিভক্ত আর সেখানেও এরকমই ছবিটা। কোনো কাউন্সিলে কোনো একটি কি দু’টি ভাষাভাষী মানুষের বাস, কোনোটা বা বেশী। নিউহ্যামে এই সংখ্যাটা বেশ বেশী। আর সে সময়, ব্রিটিশ সরকারের নীতি ছিলো, কোনো এলাকায় কোনো ভাষার পাঁচজন মানুষ যদি থাকেন, তাহলে সমস্ত প্রচারপত্র, চিঠি বা অন্য জরুরী কাগজ সেই ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। আমাদের ইউনিটের নাম পরে হয় ল্যাঙ্গুয়েজ শপ। সেখানে আমরা নব্বইটির বেশী ভাষায় দোভাষী সরবরাহ করেছি আর ষাটটির বেশী ভাষায় অনুবাদ করেছি স্থানীয় বাসিন্দা, বিশেষ করে ভিন্দেশ থেকে এসে বসবাস করা মানুষের জন্য। এমনকি আমরা ঐসব এলাকার ডাক্তারের চেম্বারে/হাসপাতালে ত্রিমুখী দোভাষীর সাহায্য দিয়েছি। যেমন ডাক্তারের সামনে একটি ফোন থাকবে যার দু’টি রিসিভার। ডাক্তারের কাছে ইংরেজি না-জানা কোনো রোগী এলে তিনি আমাদেও দফতরে ফোন করতেন। আমরা বাড়িতে বসে কাজ করেন, সেই ভাষার এমন একজন দোভাষীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতাম। একটি রিসিভার ডাক্তার নিতেন, অন্যটি রোগীকে দিতেন এবং ডাক্তার অনায়াসে রোগীর সমস্যা ইত্যাদি জেনে নিতে পারতেন।
এক সময় আমরা লন্ডন ট্রান্সপোর্ট’এর সঙ্গে সহযোগিতায় কাজ করেছি। ইংরেজি না-জানা যাত্রীরা ফোন করলে আমরা তাঁদেও সাহায্য করতাম। আমাকে কিছুদিন পর অনুবাদের বিষয়টা কোঅর্ডিনেট করার দায়িত্ব দেয় আমাদের ম্যানেজার জেমিন প্যাটেল। তিনি ছিলেন আফ্রিকার জন্ম ও শৈশব কাটানো গুজরাতি। তাঁর তারুণ্য ও উচ্চশিক্ষা বিলেতেই। অত্যন্ত দক্ষ ম্যানেজার জেমিন। কাজটা আমি খুব উপভোগ করেছি। নানা দেশীয় অনুবাদক ছিলেন আমাদের তালিকআভুক্ত, যাঁদের আমরা পরীক্ষা নিয়ে তাঁদের দক্ষতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি। তাঁরা বাড়ি থেকে কাজ করতেন। অনুবাদ হয়ে গেলে আমাকে পাঠিয়ে দিতেন। তাঁদের লেখা আমি অফিসের কম্পিউটরে লেআউট ইত্যাদি ঠিক করে অনুরোধকারী অফিসারের কাছে পাঠিয়ে দিতাম। ল্যাটিন ভাষার কাজগুলো আমার খুলতে অসুবিধা হতো না। কিন্তু বাকী ভাষাগুলো আমার কম্পিউটরে ঢোকানো ছিলো, যার ফলে আমি খুলতে ও লেআউট ঠিক করতে পারতাম।নুবাদকদের সঙ্গে আমার চমৎকার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি যখন বিদায় নিই, তাঁরা সকলে এসে দেখা করেন, কেউ কেউ উপহার দিয়েছিলেন। দু’একজনের সঙ্গে এখনো ফেসবুকে যোগাযোগ আছে। কাজটা খুব ভাল লাগতো। তবে যেতে হতো বেশ দূরে, প্রায় কুড়ি মাইল (বিলেত তখনো মাইলে দূরত্ব মাপা হতো), তবে আমি গাড়ি চালিয়ে যেতাম বলে খুব কষ্ট হতো না। আমাদের অফিস নিউহ্যাম কাউন্সিলের বিভিন্ন এলাকায় থেকেছে। সর্বশেষ যেখানে ছিলো (এখনো সেখানে আছে), সেটা টেমস নদীর তীরে। পুরো কাঁচের ভবন, আমাদের অফিস ছিলো দোতলায় আর আমার আসন দেয়ালের দিকে, যার ঠিক নিচে একটা পায়ে চলা পাকা রাস্তা আর তার পরই নদী। বিলেত ছেড়ে চলে আসার পর যেসব জিনিসের জন্য মন খারাপ হয়, তার একটি নদীর তীরের সেই মনোরম ও শ্রান্তি হরণকারী আসনটি।
ছবি: গুগল