ছুটি শব্দটাই একটু কেমন যেন! অভিধানে ছুটি শব্দের অর্থ লেখা-কাজের শেষে অবকাশ। সামনেই ঈদ উৎসব। ক্যালেন্ডারের পাতায় লাল রঙের তারিখ জানান দিচ্ছে, টানা অনেকগুলো দিন মানুষের অবকাশ মিলবে। আলস্যের আড়মোড়া ভেঙে সকাল আসবে কারো কারো জীবনে। কেউ ছুটবে শহর ছেড়ে দূরে।এই কংক্রিটে মোড়া শহরে হাঁসফাঁস করতে প্রাণ প্রকৃতির কাছে গিয়ে নিঃশ্বাস নেবে।কিন্তু ছুটি শব্দটার গায়ে হারিয়ে যাওয়ার কেমন একটা গন্ধ আছে বলে মেনে হয়। সেই গন্ধটা কি রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পে ফটিকের ছুটি মিলে যাওয়ার মতো? ফটিকের তো জীবন থেকেই ছুটি মিলে গিয়েছিলো। তবুও আমাদের কর্মযজ্ঞের ওপর সাময়িক বিরাম চিহ্ন হয়ে মানুষের জীবনে ছুটি আসে। কিন্তু সত্যিকারের অবকাশ কী মেলে? জীবন কাউকে কবে এই মত্ত পৃথিবীতে ছুটি দিয়েছে! জীবনের পথ ফুরাবার আগে ছুটি মেলে না। তবুও মানুষ ছুটি চায়। কাজের ভিড় থেকে তার ছুটি প্রয়োজন হয়। হয়তো সেটুকু অবকাশ সাময়িক তবু ছুটির প্রয়োজন হয়।
এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো ‘ছুটি’।
ছুটির সঙ্গে ট্রেনের একটা যোগাযোগ আছে। যোগাযোগ আছে স্টিমারের; আজকাল উড়োজাহাজেরও। ছুটি বললেই দৃষ্টির সামনে ভেসে ওঠে একটা আলোড়নহীন স্টেশন। কেউ একটা ব্যাগ হাতে নেমে দাঁড়ায় অভ্যর্থনাহীন প্ল্যাটফর্মে।বড় বড় গাছের মাথায় হয়তো সেদিন হাওয়া দোল খাচ্ছে, রোদ চিকচিক করছে, দূরে কোথাও একটা পুরনো সরকারী বাংলো স্তব্ধ হয়ে আছে অতিথির অপেক্ষায়। সেই নারী বা পুরুষটির সঙ্গে দেখা হবে বাংলোর বাইরে বিকেলের পড়ে আসা রোদের, কথা বলবে অচেনা পাখি। বারান্দায় বসে থেকে থেকে এক সময় সন্ধ্যা আসবে দেখা করতে। তারপর আসবে রাত। সেই ছুটি কাটাতে আসা মানুষটা গান শুনতে শুনতে হয়তো আরও অনেকটা সময় বসে থাকবে বাইরের জমাট বাঁধা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। এমন অবকাশ কোথাও মেলে? আদৌ কি পাওয়া যায়?
কথা সাহিত্যিক সমরেশ বসু‘র লেখা গল্প ‘ছুটির ফাঁদে’। গল্পটি নিয়ে পরবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছিলো চলচ্চিত্রও। অফিসের বসকে মিথ্যা বলে ছুটি নিয়ে বেড়াতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলো এক যুগল। তাদের সেই বিড়ম্বনার কাহিনিই ছুটির ফাঁদে। এই গল্পের নাম অসুরণ করেই এখন দীর্ঘ সরকারী ছুটি মিলে গেলে গণমাধ্যমে হেডিং হয়, ‘ছুটির ফাঁদে দেশ’। ছুটি কি আসলে ফাঁদ? শহরের বাসিন্দাদের কাছে এমন ছুটি তো অমূল্য। আর কিছুদিন পরেই লম্বা ছুটির ছায়ায় শহরের পথে পথে হাই তুলবে অলস হাওয়া। বিপণী বিতানের বন্ধ শাটারের গা ঘেঁষে শুয়ে থাকবে পথের কুকুর।গাড়ির হর্নের আর্তচিৎকার নেই, মানুষের সঙ্গে মানুষের ধাক্কা খাওয়া ভিড় নেই। বহু মানুষ শহর ছেড়ে ফিরবে গ্রামে।তাদের জন্য সেখানে সময় গুনছে অপেক্ষা শব্দটি। ছুটিতে ঘরে ফেরারও একটা রূপ আছে। কোথায় কোন অখ্যাত গ্রামের বাজার বাড়ি ফেরা মানুষের গল্পে মুখর হবে। মফস্বল শহরের নিরিবিলি পাড়ার গলি চমকে উঠবে চেনা মানুষের গলার স্বরে। আজকাল ছুটিতে কেউ কাউকে চিঠি লিখে বেড়াতে আসে না। একটি টিলিফোন কলই যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো ছুটির নিমন্ত্রণে কেউ কাউকে ডাকে না। মনে পড়ে, বহু বছর আগে চিঠি বাড়িতে অতিথি আগমনের আগাম সংবাদ পরিবেশন করতো। দীর্ঘ ছুটিতে মানুষের ঘরবাড়ি হেসে উঠতো অতিথির আগমনে।
পশ্চিমা দেশের সাহিত্যিকদের রেওয়াজ আছে অবকাশ নিয়ে নানা ধরণের উপন্যাস লেখার। উপন্যাসের প্রসঙ্গে এসে মনে পড়লো বুদ্ধদেব গুহ‘র বহুল পঠিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাসটির কথা। উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্রের নাম ছিলো ছুটি। ছুটির সঙ্গে প্রধান পুরুষ চরিত্র পৃথুর চিঠি বিনিময় হতো। ছুটি একবার হঠাৎ অবকাশ পেয়ে কলকাতা থেকে চলে গিয়েছিলো পৃথুর কাছে ট্রেনে চড়ে। ‘আগামী শুক্রবার আমি কোলকাতা থেকে সোজা আপনার ওখানে যাব। বৃহস্পতিবার রাতে ডুন-এক্সপ্রেসে রওয়ানা হব–গোমো-বাড়কাকানা হয়ে আপনার ওখানে পৌঁছবো। আমাকে নিতে স্টেশনে আসবেন। ট্রেন যতই লেট থাকুক, আপনি আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন। দু’জনে বাড়ি ফিরে একসঙ্গে খাব।’ ছুটি চিঠিতে আরও লিখেছিলো, ‘আপনাকে অনেক দিন দেখি না। খুব ইচ্ছা করছে আপনার মুখোমুখি বসে গল্প করতে অনেক অনেকক্ষণ।’
ছুটির গন্ধ মাখা চিঠি পৌঁছায় পৃথুর কাছে। একদিন সত্যি সত্যি ট্রেনে চড়ে ছুটিও পৌঁছায় তার গন্তব্যে।কিন্তু আমাদের এই একবিংশ শতাব্দীর ছুটি কাকে কোথায় পৌঁছে দেয়? কেউ কেউ জীবনের কাছে ছুটি নিয়ে যাত্রা করে অচেনা অন্ধকার জগতে। সে ছুটি থেকে আর ফিরে আসা হয় না কোনোদিন। কোনো কোনো ভোরবেলা ফোন আসে। কেউ জানায়, সিলিং থেকে ঝুলছে বন্ধুর প্রাণহীন দেহ। আরও বিপন্ন এক বিষ্ময় খেলা করেছিলো তার অন্তর্গত রক্তের ভিতরে।জীবনের অবকাশ তাকে ছুটি দেয়নি; সে ছুটি নিয়ে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গল্পের কাছে আরেকবার ফিরি। অতিথি গল্পের তারাপদর মতো কেউ কেউ অসক্তিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপৃথিবীর কাছে ফিরে যায়।
ছুটি বা অবকাশের সঙ্গে জড়িয়ে যায় দাপ্তরিক কতো শব্দ। অর্জিত ছুটি, সাময়িক ছুটি, বিনা বেতনে ছুটি আর বিনোদন ছুটি। অবকাশকে আমরা কত নিয়মের নিগড়ে বাঁধি। ঘর ছাড়া হয়ে পথে নেমে যাওয়ারও অরেকটা নাম ছুটি। জীবনের নিত্যদিনের রুটিন থেকে তখন মুক্তি আসে। ছুটি তো একধরণের মুক্তিও। বাউলরা যেরকম যায়, মাঝিবিহীন একটা নৌকা যেরকম ভেসে যায় অচেনা জলরেখা ধরে তেমনি মানুষের জীবনও ভেসে যায়। সেখানে প্রাত্যহিকতার তাগাদা নেই, চাল আর নুনের হিসাব নেই, ইস্ত্রি করা কাপড়ের স্লিপ নেই পকেটে। শুধু চলে যাওয়া আছে বাউণ্ডুলে বাতাসের মতো। সেই ছুটির দেখা কম মানুষ পায়। আমরা ক্যালেন্ডারের পাতায় শুধু দাগ কেটে বসে থাকি ভাবি, কবে ছুটি হবে?
ইরাজ আহমেদ
ছবিঃ গুগল