
লেখক, সাংবাদিক উর্মি রহমান প্রাণের বাংলার জন্য লিখছেন দূরের হাওয়া বিভাগে জীবনস্মৃতি; ‘মনে পড়ে’। তার শৈশব, কৈশোর জীবনের বয়ে চলা পথের গল্পগুলো এই ধারাবাহিক জুড়ে থাকব। উর্মি রহমান দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করেছেন। কাজ করেছেন বিবিসি বাংলা বিভাগেও। এখন বসবাস করেন কলকাতায়।
বিবিসি সার্বক্ষণিক কর্মীদের সবাইকেই প্রায় ডিউটি ট্যূর’এ পাঠাতো। আমি একাধিকবার গিয়েছি। এমনকি আমার যখন চুক্তিভিত্তিক চাকরি শেষ হয়ে গেলো, আমি ক্যাজুয়াল প্রযোজক হিসেবে কাজ করছি, তখনও একদিন ইস্টার্ণ সার্ভিসের প্রধান উইলিয়ম ক্রলী এসে বলেছিলেন, আমাকে তাঁরা ডিউটি ট্যূরে বাংলাদেশ পাঠাতে চান। তারপর তিনি একটু হেসে পাশে দাঁড়ানো সাগরকে বলেছিলেন, ‘স্টুডিও’র বাইরে এ ধরনের অনুষ্ঠান তুমিও ঊর্মিও মত করতে পারবে না।’ ভাল লেগেছিলো আমার ওপর উইলিয়মের আস্থা দেখে। যাহোক। আমি অনেকবারই গিয়েছি ডিউটি ট্যূরে, তার সবগুলোর কথা বলবো না। একবার গেলাম এনজিও’দের ওপর সিরিজ অনুষ্ঠান করতে।
ঢাকা গিয়ে এনজিও’দের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের এক পর্যায়ে একটি নতুন এনজিও’র কর্মকর্তা আমাকে ফোন করলেন, তিনি কিছুদিন বিবিসি’তে অনুষ্ঠান করেছেন। বললেন, ‘আমার সঙ্গে কথা না বলে তুমি তো এই অনুষ্ঠান করতেই পারবে না।’ আমি তাতে একটু বিরক্ত হলাম। বললাম, ‘আপনার সঙ্গে কথা না বলেই আমি এই অনুষ্ঠানমালা করবো।’ সেটাই করেছিলাম। সেটা করার জন্য আমি আন্তর্জাতিক ও স্থানীয়, দু’ধরণের এনজিও’র সঙ্গে কথা বলি। ফরিদপুর-খুলনা অঞ্চলে কাজ করে এমন একটি এনজিও’র কর্তা ব্যক্তি আমাদের তাঁর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন। ফরিদপুরে তাঁরা গ্রামোন্নয়নের পাশাপাশি রজনীগন্ধা ফুল ও নানা ধরণের চাষও করেন। তাঁদের সেন্টারের ঠাট-বাট একটু বেশী ছিলো। আরিচা ঘাটে দেখেছিলাম সেই ভদ্রলোককে সবাই খুব খাতির করছিলো। সেখানে একটা জিনিস খুব ভাল লেগেছিলো। কাছের এক গ্রামে কীর্তনের আসর বসেছিলো।
খুলনা থেকে কীর্তনিয়ারা এসেছিলেন। লণ্ঠন আর হ্যাজাক জ্বেলে আশেপাশের গ্রামের লোকরা ভীড় করে কীর্তন শুনছিলো। সেখানে হিন্দু ও মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ের মানুষই ছিলো। আর যেসব তরুণরা ভীড় সামলানো বা লাইন ঠিক রাখা ইত্যাদি নানা রকমের কাজ করছিলো, তারা সবাই মুসলমান। মনে হয়েছিলো, এই তো আমাদের বাংলাদেশ।
মনে পড়ে গেলো, একবার ধামরাই গিয়েছিলাম। সেখানে গঙ্গাপূজা হচ্ছিলো। দেবী গঙ্গার সঙ্গে আরো অনেক দেব-দেবীর মূর্তি ছিলো। আমি সাগরের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁরা কারা। সাগর বলতে পারেনি। একজন বয়স্ক মানুষ এগিয়ে এলেন, তাঁর দাড়ি ছিলো এবং মাথায় টুপি। আমাকে বললেন, ‘আসেন মা, আমি আপনাকে চিনায়ে দিচ্ছি।’ সেদিনও একই রকম ভাল লেগেছিলো। খুলনা যাবার পথে আমরা যশোরে বাঁচতে শেখা নামে একটি স্থানীয় এনজিও’তে গেলাম। যেটা পরিচালনা করেন অ্যাঞ্জেলা গোমেজ নামে একজন। আমরা দুপুরের পরে গিয়ে পৌঁছেছিলাম, তিনি প্রথমেই আমাদের সযতেœ মধ্যাহ্ন ভোজ করিয়েছিলেন। তারপর তাঁর এলাকা ঘুরে দেখিয়ে তাঁর সংস্থার কাজকর্ম সম্পর্কে বলেছিলেন, যা জেনে খুবই ভাল লেগেছিলো। খুলনা গিয়ে সেখানে ম্যাচ ফ্যাক্টরীর পাশে একটি বস্তিতে গিয়েছিলাম, যেখানে একটি স্থানীয় এনজিও কাজ করে। বস্তিবাসী যেসব নারী কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তাঁরাও মনে ছাপ ফেলেছিলেন। এরপর চট্টগ্রাম যাই। সেখানে উপকূল এলাকায় কাজ করে এমন একটি এনজিও’র সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
তাঁরা তাঁদের প্রকল্প দেখাতে নিয়ে গেলেন উপকূল অঞ্চলের একটি মৎস্যজীবীদের গ্রামে। গ্রামটির নাম উত্তর সেলিমপুর। সেখানে দেখলাম প্রাকৃতিক দূর্যোগের সঙ্গে তাঁদের লড়াই করে বাঁচতে হয়। সেবার আরো কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠনের মদদপুষ্ট এনজিও’র সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু তাদের কারো কারো ওভারহেড খরচ বেশী, কারো ঠাঁটবাটও আছে। কিন্তু স্থানীয় এনজিওগুলো নিজস্ব চেষ্টায় এসব কাজ করে এবং ভাল কাজ করে। পরে আর একবার গিয়েছিলাম উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণ উপকূলে। উত্তরে রংপুর গিয়ে দেখি সেখানে বিশাল একটি মোটেল করা হয়েছে জেনারেল এরশাদের আমলে, কিন্তু সেখানে থাকার মত কেউ নেই। গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম গেলাম। এক জায়গায় দেখি ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে এরশাদের তৈরী গুচ্ছগ্রাম। নদী ও বাঁধের ঠিক মাঝখানে গুচ্ছগ্রামের ঘর এবং প্রতি বছর বন্যার সময় সেগুলো ডুবে যায়। মানুষগুলো তখন যা পারে তাই নিয়ে বাঁধের ওপর উঠে যায়। তাঁরা অবশ্য খুব বেশী অভিযোগ করলেন না, কারণ রংপুরের ভূমিপুত্র হিসেবে জেনারেল এরশাদের প্রতি তাঁদের সমর্থন ছিলো।
আমি যখন জানতে চাইলাম, ‘ঘূর্ণিঝড় বা বন্যা হলে সরকার সাহায্য করে না?’ একজন বৃদ্ধা হাত নেড়ে বললেন, ‘সরকার আর নাই, বাহে। বুঝলাম তাঁদের কাছে সরকার মানে জেনারেল এরশাদ, তিনি তখন কারাগারে। দক্ষিণে কক্সবাজার গিয়ে সেখান থেকে মহেশখালি ও বদরখালি গেলাম। বদরখালিতে উবিনীগের একটি কেন্দ্র আছে। সেখানে বাজারে গিয়ে নানা ধরণের মানুষের সঙ্গে কথা বলি। তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা শুনি। সেখানেও প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়। মানুষগুলো প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে। সেখানে রাতে কোনো আলো ছিলো না। উবিনীগের রাখীর সঙ্গে অন্ধকারে সমুদ্রের তীরে হেঁটেছিলাম। খুব ভাল লেগেছিলো। পরে জেনেছিলাম যেদিন বিবিসি’তে তাঁদের এলাকা নিয়ে এই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়, সেদিন বদরখালির বাজারে মাইক লাগিয়ে সেটা সবাইকে শোনানো হয়।
ছবি: গুগল