
লেখক, সাংবাদিক উর্মি রহমান প্রাণের বাংলার জন্য লিখছেন দূরের হাওয়া বিভাগে জীবনস্মৃতি; ‘মনে পড়ে’। তার শৈশব, কৈশোর জীবনের বয়ে চলা পথের গল্পগুলো এই ধারাবাহিক জুড়ে থাকব। উর্মি রহমান দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করেছেন। কাজ করেছেন বিবিসি বাংলা বিভাগেও। এখন বসবাস করেন কলকাতায়।
আগেই বলেছি বিবিসিতে এক বুলগেরিয়ান সহকর্মী রোজার সঙ্গে আমি একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলাম। সবাই বললো, ‘বাড়ি ভাড়া করে থাকার কোনো মানে হয় না, যেখানে তুমি সহজেই বাড়ি

কিনতে পারো। এদেশে সহজে মর্টগেজ পাওয়া যায়, যা বাড়ি ভাড়ার চেয়ে হয়ত কমই হবে আর সবচেয়ে বড় কথা টাকাটা তোমারই থাকবে। বাড়ি তোমার। বিক্রি করলে সেই টাকা ফেরত আসবে। রোজা জানালো সে-ও বাড়ি কেনার কথা ভাবছে। আমি ঊডগ্রীণ এলাকায় থাকতে চাই আর ও আরো উত্তরে যেতে চায়। আমি যেখানে থাকতাম, সেখানেই পছন্দসই একটা বাড়ি পেলাম আর রোজা পেলো বেলসাইজ পার্ক এলাকায়। আমি বাড়ি কেনার প্রক্রিয়া শুরু করলাম। মর্টগেজ পেতে আর বাকী সব কাজ পূরণ করতে সময় লাগে।আমাদের দু’জনের মধ্যে কথা হলো যে, যার বাড়ি আগে হবে, অন্যজনের বাড়ি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে থাকবো। রোজার একটা বাড়ি ছিলো লন্ডন শহরের বাইরে। সেটা বিক্রি করে ও লন্ডনের বাড়ি কিনলো। ফলে ওরটা আগে হলো আর ভাড়া বাড়ি ছেড়ে রূপককে নিয়ে আমি ওর সঙ্গে চলে গেলাম। সেখানে মাস পাঁচেক থাকার পর আমার বাড়ি কেনা সম্পূর্ণ হলো। তখন আমি আর রূপক নতুন বাড়িতে চলে এলাম। বাড়িটা একটা ইংরেজি এল শেপের রাস্তার শেষ মাথায়। দোতলা বাড়ির একতলার ফ্ল্যাটটা আমি কিনলাম। এই বাড়িগুলোকে বলে মেসোনেট। নিচের তলার ফ্ল্যাটটা ছাড়াও বাগানের অর্ধেক আমার ছিলো। আমাদের বাড়িটার পরেই স্কুল আর তারপর বড় একটা মাঠ। রূপককে ঐ স্কুলে ভর্তি করে দিলাম আর ঐ মাঠটা পেয়েও রূপক খুব খুশি হলো। লন্ডনের নিয়ম প্রতিটা স্কুলে কয়েকটা রাস্তার বাচ্চারা অগ্রাধিকার পাবে। তাকে বলে ক্যাচমেন্ট এলাকা। ফলে রূপকের আগের স্কুল থেকে সেখানে স্থানান্তর করতে কোনো অসুুবিধা হলো না।
আমাকে জামাকাপড় পরে ওকে স্কুলে দিয়ে আসতে হতো না। আমি দরজায় দাঁড়াতাম আর ও দৌড়ে স্কুলে ঢুকে যেতো। বাড়ি তো কিনলাম। কিন্তু মর্টগেজ শোধ করাটা যাতে সহজ হয়, সেজন্য আমি লজার রাখতে শুরু করলাম। দু’টো শোবার ঘর ছিলো। রূপক ছোট বলে আমার সঙ্গেই শুতো। আমার লজাররা ছিলো নানা জাত ও বর্ণের। একটা কুর্দী মেয়ে ছিলো নাসরিন, যার বিয়ে আমাকেই দিতে হয়েছিলো। ও খালাতো ভাইকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করাতে দুই পরিবারের কেউ রাজী ছিলো না। সেই বিয়েতে উকিল বাপ হয়েছিলেন ফেরদৌস কোরেশী ভাই। অন্য একটা মরিশান মেয়ে ছিলো। তারপর বিবিসির আফগান একটা ছেলে ছিলো। সে খুব আজব ছিলো। ফ্রিজার থেকে বরফে জমাট মাংসের বড় একটা টুকরো বের করে সেটাকে থ’ না করে সরাসরি ফুটন্ত তেলে দিয়ে রাঁধতো। এরপর এলো সাফিয়া, পশতু সার্ভিসের নবনিযুক্ত সদস্য। সেকশনের প্রধান গর্ডন অ্যাডামস একদিন বললেন, “তুমি তো একাই থাকো। একটা নতুন মেয়ে

এসেছে। ও কি তোমার সঙ্গে থাকতে পারে?” আমি রাজী হলে গর্ডন নিজেই ওকে দিয়ে গেলেন। সাফিয়া অনেকদিন ছিলো আমার সঙ্গে।
ওর সঙ্গে আমার গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিলো, আজও সেই বন্ধুত্ব অটুট আছে। আমার ঐ ছোট্ট ফ্ল্যাটে অনেকে এসে থেকেছেন। একবার ঈদের দিন সেলিনা (হোসেন)আপা, তাঁর স্বামী আনোয়ার ভাই, বন্ধু মুনতাসির মামুন, স্নেহভাজন ফারুখ ফয়সল, এরা সবাই ছিলো। গল্পে-আড্ডায় আর ঈদের খাওয়া-দাওয়ায় খুব ভাল কেটেছিলো সেই রাতটা। নাহলে আমার আর রূপকের তো ঈদ করা হয় না। আমার বড় বোনের ভাশুর মাসুদ হাসান জামালী ও তাঁর ছেলে বাংলাদেশের জুনিয়র টেনিস চ্যাম্পিয়ন শোভন জামালী এসেছিলেন। মাসুদ ভাইজান বাংলাদেশের টেনিস কোচ ছিলেন। আমাকে খুব স্নেহ করেন।
কলকাতা থেকে বিখ্যাত সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সুনন্দা বৌদি এসে ছিলেন। তাঁর আদি বাড়ি সিলেট বলে তাঁকে ব্রিকলেনের দোকানীরা খুব সমাদর করেছিলো। অমিতাভদা চমৎকার মানুষ ছিলেন, আড্ডবাজ, ¯েœহপ্রবণ। মুখে মুখে ছড়া বা কবিতা বানাতে পারতেন। তিনি আমাকে ও রূপককে নিয়ে ঊডগ্রীণের পটভূমিতে একটা ভূতের গল্প লিখেছিলেন। পরে ফিরে গিয়ে কলকাতা থেকে কেউ লন্ডন এলে বলতেন, “ঊর্মিকে দেখে এসো।” বলাবাহুল্য এত বড় লন্ডন শহরে কোনো এক ঊর্মিকে খুঁজে পাওয়া অত সহজ নয়। ঘটনা চক্রে একবার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বন্ধু নমিতার বাড়িতে দেখা হয়ে গেলে তিনি অবাক হয়ে বলেছিলেন, “ও আপনইি সেই ঊর্মি যাঁর কথা অমিতদা আমাকে বলেছিলেন।” আমি হেসে বলেছিলাম, “এবার গিয়ে অমিতদাকে বলবেন, আমি ভাল আছি।”