
লেখক, সাংবাদিক উর্মি রহমান প্রাণের বাংলার জন্য লিখছেন দূরের হাওয়া বিভাগে জীবনস্মৃতি; ‘মনে পড়ে’। তার শৈশব, কৈশোর জীবনের বয়ে চলা পথের গল্পগুলো এই ধারাবাহিক জুড়ে থাকব। উর্মি রহমান দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করেছেন। কাজ করেছেন বিবিসি বাংলা বিভাগেও। এখন বসবাস করেন কলকাতায়।
আমি আর সাগর ঠিক করলাম এবার একটা বাড়ি কিনবো। এবারে যেটা কিনলাম, সেটা ফ্ল্যাট নয়, একটাদোতলা বাড়ি। ঐ একই পাড়ায়, রূপকের আগের স্কুল যে রাস্তায়, সেই রাস্তাতেই। বাড়িটার দোতলায় তিনটি শোবার ঘর আর নিচে একটা বড় হল এবং বেশ বড় রান্নাঘর। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা যখন বাড়ি দেখতে এসেছিলাম, তখন নিচের তলা, বিশেষ করে রান্নাঘর দেখার পর যখন বাড়ির তখনকার মালিক বললো, ‘চলো তোমাদের শোবার ঘরগুলো দেখাই,’ তখন আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বাংলায় সাগরকে বলেছিলাম, ‘ওপরতলা দেখার দরকার কি? আমি এই বাড়িই কিনবো।’ বাড়ির চাবি হাতে পাবার পর যেদিন সে বাড়িতে ঢুকবো, তার আগের দিন সন্ধ্যায় আমরা দু’জনে বাড়িটায় গেলাম যাতে সেটা পরিষ্কার করে রেখে আসতে পারি। গিয়ে দেখি আগের বাসিন্দারা বাড়ি ঝকঝকে তকতকে করে রেখে গেছে।

আমরা চলে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছি, তখন হঠাৎ দরজায় কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখি একটা ফুটফুটে শ্বেতাঙ্গ বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সে বললো, ‘আমার মা বলেছে, তোমরা নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত। তোমরা কি চা খাবে?’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কোথায় তোমার মা?’ সে আঙুল দিয়ে পাশের বাড়িরঘরের দিকে নির্দেশ করতে দেখি একজন মহিলা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। পরে জেনেছি তার নাম সুজান বা স্যু। ওর স্বামীর নাম স্টিভ, ওদের দুই ছেলে নিক আর লী। সেই আলাপ পরে গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়, যা আজও, দুই দেশে থাকা সত্ত্বেও অটুট আছে। অন্য পাশের বাড়ির বয়স্ক দম্পতি রেজ আর জয়েসও খুব ভাল ছিলো। রেজ আমাদের ছোট বাগানের ঘাস কেটে দিতো আর সাগরকে বলতো, ‘তোমার এ ব্যাপারে ন্যাক নেই। আমিই সবসময় তোমার ঘাস কেটে দেবো।’ রেজকে নিয়ে একটা মজার কথা আমরা আজও মনে করি। ও ঘাস কাটতে কাটতে এক ফাঁকে সাগরকে বলতো, ‘দাঁড়াও, বাড়ি গিয়ে একটু হুইস্কি খেয়ে আসি।’ সাগর অবাক হয়ে বলেছিলো, ‘সেকী! এই সকাল বেলাতেই?’ রেজ বলেছিলো, ‘পৃথিবীর কোথাও না কোথাও তো এখন সন্ধ্যা হয়েছে।’
রূপক আবার আগের স্কুলে ভর্তি হলো। এখানেও ও নিজেই দৌড়ে স্কুলে গিয়ে ঢুকতো, আমি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। ও যখন ফিরতো, তখন আমরা দু’জনেই অফিসে। ও চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকে যেতো আর পাশের বাড়ি থেকে স্যু লক্ষ্য রাখতো। রূপক অবশ্য তখন একটু বড় হয়েছে। আমাদের একটা চাবি যেমন স্যু’র কাছে থাকতো, তেমনি ওদেরও একটা চাবি আমাদের কাছে ছিলো। আমাদের বাঙালিদের মত স্যু’র যদি বাড়িতে চিনি বা পেঁয়াজ না থাকতো, তাহলে ও এসে আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে যেতো,

একটা চিরকূটে সেকথা লিখে রেখে যেতো। এই বাড়িটা থেকেও টিউব বা পাতাল রেল স্টেশন কাছেই ছিলো। এই লাইনটা সোজা হিথরো বিমান বন্দর পর্যন্ত যায়। আমরা এই বাড়ি থেকেই লন্ডন ছেড়েছিলাম। আমাদের এই বাড়িতেই কত বন্ধু-পরিচিতরা এসে থেকে গেছে, আর অপরিচিতও। একবার দৈনিক সংবাদের এক সাংবাদিক হিথরো বিমান বন্দর থেকে ফোন করে বলোিছলো, “আমাকে আমেরিকায় ফারুখ ফয়সল বলেছে,‘ আমি আপনার বাড়িতে কয়েকদিন থাকতে পারি।
আমি কি আসবো?’ সেরকম সেজান মাহমুদ, রতন নামে এক তরুণও থেকে গেছে, যাদের আগে চিনতাম না। এই বাড়িতেই শামসুর রাহমান, বদরুদ্দিন উমর, সেলিনা হোসেন, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, আসাদুজ্জামান নূর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আব্দুল মান্নান, মফিদুল হক-সীমা মোসলেম দম্পতি, শাহরিয়ার কবির, সুলতানা কামাল, আমার ভগ্নীপতি ড. ওয়াহিদুদ্দিন মাহমুদ প্রমুখ অনেকেই থেকেছেন। আরো অনেকে এসেছেন অতিথি হয়ে, কিন্তু থাকেননি, তাঁদের মধ্যে আছেন বেগম সুফিয়া কামাল, আমার শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামান, রামেন্দু মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখখোপাধ্যায়, আনন্দ প্রকাশনার দায়িত্বে যিনি ছিলেন, সেই বাদল বসু আরো অনেকে, সবার নাম আজ আর মনে নেই। । তাঁরা এলে আমাদের সময়ও খুব ভাল কাটতো। এই বাড়িতে কত আড্ডা, কত পার্টি হয়েছে। বন্ধুদের অনেকে এখনো আমাদের বাড়িটার কথা মনে করে। এখানে থাকতে থাকতেই রূপক প্রথম প্রাইমারী স্কুল শেষ করে হাই স্কুলে গেলো। সেখান থেকে ক্যান্টারবেরী শহরে অবস্থিত ইউনিভার্সিট অব কেন্ট’এ। এখনো লন্ডনের কথা ভাবলে ঊডগ্রীণের এই বাড়িটার কথা মনে পড়ে আর মনটা খারাপ হয়ে যায়।
ছবি: লেখক