
ঋত্বিক ঘটকের যা পাগলামী, ঝগড়া সব ছিলো আমার সঙ্গে। শ্যুটিং ফ্লোরে উনি ছিলেন ভীষণ শান্ত এক মানুষ। কাজের জায়গায় ওনার কোনো পাগলামী দেখিনি কোনোদিন। অনেকদিন এমনও গেছে শ্যুটিংয়ে আসার আগে মদ্যপান করেছেন। আমি ভয় পাচ্ছি, ভাবছি শ্যুটিং করতে গিয়ে হয়তো গোলমাল করে ফেলবেন। কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখতাম স্পটে এসে ক্যামেরাটা স্পর্শ করে তিনি হয়ে যেতেন অন্য মানুষ। সজোরে হাঁক দিতেন চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলামের নাম ধরে। তারপরই মানুষটা ম্যাজিকের মতো বদলে যেতেন।কাজটা ছিলো তার কাছে প্যাশন।
তিতাস নদীতে শ্যুটিং শেষ করে আমরা ঢাকায় ফিরি। তারপর এফডিসিতে সেট তৈরী করে কাজ শুরু হয়। ওটা ছিলো চার পাঁচ দিনের কাজ। এখনকার এফডিসির মূল অফিস ভবনের পেছনে সেট পড়েছিল আমাদের। তখন সদ্য দেশ স্বাধীন হয়েছে। শ্যুটিং করার প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা, প্রয়োজনীয় কাজের লোক পাওয়া যেতো না। শ্যুটিং করতে গিয়ে অনেক ঝক্কি পোহাতে হতো আমাদের। এফডিসিতে কাজ করার সময় ঢাকার সিনেমার অনেক অভিনেতা, অভিনেত্রীরা আসতেন আমাদের কাজ দেখতে। আড্ডা দিতেন তাঁরা্।
কথা বলতেন ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে। তবে সেটে উনি খুব বেশী আড্ডা দিতেন না। নিজের কাজের মধ্যেই ডুবে থাকতেন।এই ছবির কাজ করার ফাঁকে ঋত্বিক ঘটক বেশ কয়েক দফায় কলকাতায় গেছেন। মাঝে ওনার শরীরও ভালো ছিলো না। প্রতিবারই তার সঙ্গে আমিও কলকাতায় গেছি। তখন আমার দিনরাত্রির পুরো সময়টাই কাটতো তাঁর সঙ্গে। নিজের পরিবারের মানুষদের সঙ্গেও যোগাযোগ কমে গিয়েছিলো। আসলে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমাটা আমার কাছে ছিলো একটা যুদ্ধের মতো। একাত্তর সালে লড়াই করেছিলাম দেশের স্বাধীনতার জন্য। আর সিনেমাটা ছিলো আমার কাছে দ্বিতীয় যুদ্ধ।একটা মজার কথা মনে পড়লো সেটা এখনি বলে রাখি। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমার স্ক্রিপ্টটা আমার কাছে ছিলো ভীষণ এক মূল্যবান জিনিস। সারাক্ষণ ওটা আমার কাছেই থাকতো, কাউকে ধরতে দিতাম না। যদিও ওই স্ক্রিপ্ট নিয়ে তাঁর সঙ্গে খুব বেশী আলোচনায় যেতাম না।
আমার সঙ্গে প্রায়ই ওনার ঝগড়া হতো। পুরো ব্যাপারটাই ছিলো একতরফা। উনি ঝগড়া করতেন আর আমি শুনে যেতাম। খুব একটা উত্তর দিতাম না। একদিন হঠাৎ রেগে গিয়ে আমাকে বললেন, ‘তর ছবি আমি আর করুম না।’ এরকম কথা তাঁর মুখ থেকে আমি শ্যুটিং চলার সময় আরো অনেকবার শুনেছি। আমি খুব শান্ত গলায় সেদিন বলেছিলাম যে আমার এই ছবিটার কাজ আপনাকে শেষ করতে হবে এটা আপনি জানেন না। এটা শেষ করতেই হবে। আমার উত্তর শুনে আরো রেগে গেলেন তিনি। বললেন, ‘অনউইলিং হর্স দিয়ে কোনো কাজ করানো যায় না।’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘সেরকম হলে অনউইলিং হর্সকে গুলি করে মেরে ফেলা উচিত।’
আমার কাছ থেকে এরকম উত্তর উনি আশা করেন নি। আমারও বোধ হয় একটু রাগ হয়েছিলো। উনি ক্ষিপ্ত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন,
‘কী বললি তুই?’
আমি একটু হেসে বলেছিলাম,
‘আপনাকে না, ঘোড়াটাকে মেরে ফেলা উচিত।’
অনুলিখনঃ ইরাজ আহমেদ
ছবিঃ গুগল
No Comment! Be the first one.