
স্বরূপ জাহিদ (লেখক)
রোজা প্রায় শেষ। ওহ, ভুল বললাম বোধহয়; বলতে হতো, রামাদান প্রায় শেষ। রোজার ঈদ নয়, রামাদানের ঈদ এলো বলে। সে যাই হোক, ইদ যে লিখতে হচ্ছে না, এই ঢের বেশী। যদিও আমাদের ঢাকাবাসীদের আজকাল ‘ইদ’ নাকি ‘ঈদ’ তা নিয়ে হেলদোল নেই খুব একটা। তারা বরং আছেন এই আনন্দে যে, কয়দিনের জন্যে ঢাকা ফাঁকা হচ্ছে। যাক বাবা, এই কয়দিন তো একটু নিঃশ্বাস নেয়া যাবে রাস্তায়। জ্যাম নেই, হর্ন কম, শখে গাড়ি চালানো যাবে এই ক‘দিনেই। কপালপোড়া ঢাকাবাসী এখন মনে হয় ঈদের আনন্দটা খুজে নেন ফাঁকা ঢাকার রাস্তায়। মাঝেমধ্যে মনে হয় ঈদ কিভাবে এই নগরবাসী একদা উদযাপন করতেন, তা তারা ভুলেই গেছেন।
এ শহরে ‘চাঁন রাইত’ দিয়ে একসময় শুরু হতো ঈদ উদযাপন। বেশীদিন আগে কথা নয়। সাকুল্যে তিন দশক। শেষ রোজার ইফতারটাও ঠিক মতো খাওয়া হতো না বোধহয়। পাড়ার প্রায় প্রতিটা ছাদে ভিড় জমে যেতো। সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে। ঈদের চাঁদ খোঁজার কী যে আগ্রাণ চেষ্টা! তখনোও চাঁদ দেখা কমিটি ছিলো। তবে সেই কমিটির ঘোষনার থোড়াই কেয়ার করতেন তারা। নিজের চোখেই চাঁদটা দেখা চাই। কোনোরকমে যদি ঢাকার আকাশে চাঁদ দেখা যেতো, তাহলে তো কথাই নেই। হাততালি, একে অপরেকে জড়িয়ে ধরা তো আছেই, শুরু হতো পটকা ফাটানো। সাইরেনও বাজতো একই সঙ্গে। সাইরেন, পটকা, চীৎকার সব মিলিয়ে পাড়ায় পাড়ায় সে কী এক তুলকালাম কান্ড! বোঝা যেতো, আগামীকাল ঈদ। পুরোনো ঢাকার গলিতে গলিতে কমবয়সী ছেলেরা রাস্তার মোড়ে বসে যেতো গান বাজানোর ডেকসেট নিয়ে। হিন্দি গানের আওয়াজে পাড়া কাঁপতো। নাজিরাবাজার, বেচারাম দেউরী থেকে চলে আসতো প্যাকেট ভর্তি তেহারী-বিরিয়ানী। গানের সংগে চলতো বেশুমার খাওয়া। সেই খাওয়ার সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তো পাড়াজুড়ে। প্রতিটা সেলুনে পড়ে যেতো চুল-দাড়ি কাটার লাইন। হাপিয়ে যেতেন ক্ষৌরকার । তারপরও তাদের আনন্দ চোখমুখে। ব্যবসাটা তো চানরাইতে-ই।
প্রতিটা বাসায় তখন বড়ো হাঁড়িতে মাংস চড়ানো আর সেমাই রান্নার আয়োজনে মা খালাদের উর্ধশ্বাস অবস্থা। কাল সকালেই এই খাবার নামাজের পর পরই পরিবেশন করতে হবে। তাই রান্নাটা একটু এগিয়ে রাখা। বাচ্চারা তাদের ঈদের জামা কোথায় লুকিয়ে রাখবে, তা নিয়ে মহাচিল্তায়। কারণ এই চানরাইতেই নাকি ঈদের জামা ফাঁস হয়ে যায়। তাই কোনোভাবেই বন্ধুদের ঈদের সকালের আগে জামা দেখানো যাবে না। কতো যে প্ল্যান সেই জামা লুকানোর। এসব হাঙ্গামার মধ্যেই যে কখন মধ্যরাত পেরিয়ে যেতো, নগরবাসী তা বুঝতেই পারতেন না। যখন মসজিদের মাইকে সকালের ঈদের জামাতের সময় ঘোষনা করা হতো, তখন মনে হতো, এখন ঘুমানোর সময় হয়েছে। সকালে ঈদের জামাত পড়তে তো হবে। এবার তবে চান রাত শেষ হোক।
ঈদ সকাল মানেই ঈদের জামাত। গোসল করে পুরুষরা তৈরি নতুন পাঞ্জাবি পরে। ঢাকা শহরে এক সময় ঈদের সকালে মাঠা, লেবু শরবত নিয়ে মসজিদের পাশে বসে যেতো ব্যবসায়ীরা। মসজিদে ঢোকার আগে মাঠা বা শরবত না হলে চলতোই না এ শহরের মানুষদের। পাড়ার মসজিদ কমিটির মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো, কে কার চাইতে বেশী টাকা দিয়ে বাইরের নামকরা ইমাম নিয়ে আসবেন ঈদের জামাত পড়ানোর জন্যে। এ যেনো এক আভিজাত্যের প্রতিযোগিতা পাড়া থেকে পাড়ায়। বড়ো জামাত এখনকার মতো তখনো অবশ্য জাতীয় ঈদগাহতেই হতো। আর বায়তুল মোকাররম মসজিদ তো আছেই। ঈদের জামাত কোথায় পড়া হবে, সবার জন্যে তা ছিলো এক উত্তেজনার বিষয়।
এক সময়ের সাধারণ ঢাকা শহরে ঈদের ভোজ কিন্তু মোটেই সাধারণ ছিলো না। নামাজে শেষে বাড়ী ফিরলেই ঘি আর পায়েসের গন্ধে চারদিক মৌ মৌ করতো। আশে পাশে সব বাড়ির সবাই এ পাড়া ও পাড়া করতেন সেগুলো চেখে দেখতে। সেমাই, পায়েসের বিভিন্ন পদ তো থাকতোই, সংগে থাকতো পরোটা মাংস বা খিচুড়ি- তেহারী। আর এসব পদের ভুড়িভোজটা হতো সকালেই একে অন্যের বাড়িতে। বাচ্চাদের পাড়া বেড়ানো আর ঈদি বা ঈদ সেলামির হাত থেকে বড়োদের রেহাই নেই। ঈদি তোলার এই আনন্দ চলতো সকাল পেরিয়ে রাত পর্যন্ত। প্রতিটা বাসায় জমাট আড্ডা চলতো গভীর রাত পর্যন্ত। রাতের আড্ডার ফাঁকেই সবার চোখ থাকতো টিভির পর্দায় আনন্দমেলায়। কখনো আনিসুল হক আবার কখনো বা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের উপস্থাপনায় আনন্দমেলার জন্যেই তো সবার সারা বছরের অপেক্ষা। আর হুমায়ূন আহমেদ তো থাকতেনই তার প্নাটক নিয়ে প্রবলভাবে।সবেধন নীলমনি বিটিভির এই ঈদ বিনোদন যেনো মনে করিয়ে দিতো উৎসবে ভাসছে আজ সবাই। গত বছর ঈদের সেমাই কেনার সময় আমার স্ত্রীর প্রবল আপত্তি। তার অভিযোগ, এতো সেমাই কিনি কেনো? ঈদের দিন সকালে তো কেউ বেড়াতে আসে না আমাদের বাড়িতে। আগের সেই ঈদ নেমন্তন্ন আর নেই এই শহরে। কি হবে এতো আয়োজন করে ? সত্যি তো। এখন এ শহরে শেষ রোজায় কেউ আর ছাদে যায় না চাঁদ দেখতে। বরং সবাই টিভিতে ব্রেকিং নিউজের স্ক্রলের জন্যে অপেক্ষা করে। চাঁদ এখন আর আকাশে না, টিভিতে ওঠে । আমার ছেলেকে কয়েক বছর আগে বলেছিলাম, ঈদে কী নিবি? এমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিলো, এরপর থেকে আর জিগ্যেস করি না। এই প্রজন্মের কাছে ঈদের জামার কোনো প্রয়োজনই নেই, সেখানে লুকিয়ে রাখার আনন্দ তো বাদই দিলাম। সব পাওয়ার এ শহরে আজ তাদের কাছে হয়তো অন্য আনন্দ আছে। যা হয়তো আমরাই বুঝতে পারি না। ঈদ সেলামি দেখলাম এ বছর বিকাশ আ্যাপে দেয়া যাচ্ছে। ঈদ বিনোদনে টিভি চ্যানেলগুলো এতো অজস্র অনুষ্ঠান তৈরি করে যে হাপিয় উঠতে হয়। আর ঈদের আড্ডা? কে কার সঙ্গে দেবে?যারা ঢাকার বিত্তবান, তারা তো প্লেনে চেপে উধাও হয় ব্যাংকক নয়তো সিংগাপুরে। যারােএই শহরেই থেকে যান তারা কোনো রকমে ঈদের নামাজটা পড়েই রিসোর্টে পাড়ি জমান নিরিবিলিতে ছুটি কাটাতে। ব্যস্ত আর ইট পাথরের দুষিত এ শহর থেকে যতো পালিয়ে থাকা যায় আর কী।বদলে যাওয়া শহরের ঈদ আনন্দ তাই তার রূপ পাল্টেছে। মেগাসিটির এই আনন্দ আজ তাই বড়োই আত্মকেন্দ্রিক। এ শহর আমার অচেনা লাগে এখন।
ছবিঃ গুগল