
(লেখক, সাংবাদিক)
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাইরে বাংলা ভালো যত গান, আবেদন সৃষ্টি করা যত গান, তার সবই দিয়ে গেছেন সলিল চৌধুরী আর শচীন দেব বর্মণ, মানে এসডি বর্মণ। এক্ষণে একটু কথা বলা যাক, সলিল চৌধুরী আর তার গান নিয়ে। সলিল চৌধুরীরা তখন কমিউনিস্ট পার্টি করছেন। মানুষকে জাগানোর জন্যে গড়ে তুলেছেন গণনাট্য সংঘ। প্রতিদিন গান লিখছেন, তাতে সুর করে দল বেঁধে গাইছেন। গান নিয়ে যাচ্ছেন মানুষের কাছে। সলিল চৌধুরীর গান হয়ে উঠছে মানুষের গান। ‘তোমার কাস্তেটারে দিয়ো জোরে শান কৃষাণ ভাইরে’-র মতো গান তখন যেমন রচিত হচ্ছে, তেমনি ভারত ভাগের যন্ত্রণা নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে ছড়া ‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো/ তারবেলা?’ গান করতে হলে গান শিখতে হয়, বুঝতে হয়। তারও বেশি প্রয়োজন গলায় সুর থাকা। সলিল চৌধুরীর কাছে একদল তরুণ গেছেন একটি গানের দল করার পরামর্শ দিতে।
সলিল তাদের সব কথা, আগ্রহ মন দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন, গান গাইবে, গানের দল করবে, ভালো কথা। কিন্তু গলায় সুর আছে তো? এই হলেন সুরের মানুষ সলিল চৌধুরী। তার লেখা, তার সুর করা গান শুনতে শুনতেই আমরা বড় হয়েছি। তার কন্যা অন্তরা চৌধুরীর গাওয়া ‘বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে/ আয় না যানা গান শুনিয়ে’, কিংবা ‘ও মাগো মা অন্য কোনও গল্প বলো’ আমাদের শৈশবকে সমৃদ্ধ করেছে। আবার তারুণ্যে তার স্ত্রী সবিতা চৌধুরীর গাওয়া ‘হলুদ গাঁদার ফুল দে এনে দে’র মাদকতা আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সুরের সমুদ্রে।

২. ভদ্রলোক অবাঙালি, নাম ইশু বা জেশু দাশ যা-ই হোক, গাইছেন ‘নাম শকুন্তলা তার…’ শকুন্তলা উচ্চারণ করতে গিয়ে ‘শকন্তলা’ বলছেন, তারপরও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কণ্ঠের জাদু দিয়ে। ১৯৭৯ সালে সলিল চৌধুরীর কথা আর সুরের এই গানটির আরেক চমক হলো সলিলপত্মী সবিতা চৌধুরীর গলা। তিনি যখন একটু এলিয়ে দিয়ে সুর লাগান ‘রাজাধিরাজকুমার, মনমৃগ সে করে শিকার’ তখন অন্যরকম একটা মূর্চ্ছনার সৃষ্টি হয়। আর আমি ভর সন্ধ্যায় উত্তরার এক বন্ধ ঘরে বসে ভাবি, ভাবতে থাকি, গানটা যখন রেকর্ড হচ্ছিল, ১৯৭৯ সালে তখন সবিতার বুকের ভেতর, মনের ভেতর কী খেলা করছিল? আর ভাবি এমন মিষ্টি-সুরেলা গলার একজন বাঙালি থাকতেও সলিল চৌধুরী অবাঙালি, মারাঠি ভাষী লতা মুঙ্গেশকরকে দিয়ে কেন এত এত বাংলা গান গাইয়েছেন যার সবগুলো এখন কিংবদন্তী হয়ে গেছে!
সবিতা চৌধুরী হয়ত গান-বাজনা ছেড়ে দিয়েছেন অনেক অভিমানে। কিছুদিন আগে কন্যা অন্তরা চৌধুরীর সঙ্গে কোনও একটা টেলিভিশনে গাইতে দেখলাম তাকে। এই ভদ্র মহিলার গলা শুনলে এখনো আমার মনে হয়, সবিতা চৌধুরীর প্রতি সলিল চৌধুরী একটু অবহেলাই করেছেন। আবার এটাও মনে হয়, নাম শকুন্তলা যেশুদাশ ছাড়া অন্যকেউ গাইলে ওই ঢেউ, অমন আবেদন কি সৃষ্টি হতো? যেমন ‘দূরে প্রান্তরে’ গানটা সলিল গাইয়েছেন লতাজির আরেক বোন উষা মুঙ্গেশকরকে দিয়ে। ঝলমলে গলা। বোঝাই যায় না লতা না অন্য কেউ! গানটা ১৯৭৩ সালের। আবার ১৯৭৭ সালের রেকর্ড করা একটা গান ‘হঠাৎ ভীষণ ভালো লাগছে’। গানটা লতার গাওয়া, বেজে উঠলেই মন নেচে ওঠে, সত্যি সত্যি চারদিকের সব কিছুকে ভালো লাগতে শুরু করে। ‘হায় ফাগুন দিন/ কত রঙিন/ সে আমার কামনার-সাধনার দিন/ হায় ফাগুনের দিন, কোথা গেল?’ ১৯৭৩ সালে সলিল চৌধুরী গানটি রেকর্ড করিয়েছিলেন অনুপ ঘোষালকে দিয়ে।
অনুপ ঘোষালের ঢেউ দেওয়া গলায় যখন ‘কোথা গেল’ বলে ওঠেন, তখন সলিলের ক্ষমতাটা একটু আঁচ করা যায়। অথবা রানু মুখোপাধ্যায়ের আদুরে কন্ঠে যখন ‘আকাশ কুসুম দিয়ে আমি গেঁথেছি যে হার’ গেয়ে ওঠেন, তখন সলিলকে জাদুকর মনে হয়। সেই ভর সন্ধ্যায় আমি শুনছিলাম সারেগামা থেকে বের হওয়া ‘লেজেন্ডস’ নামে কিংবদন্তী সুরকারের সেরা গানের সম্ভার। ভলিউম-৪। এই পর্বে সলিল চৌধুরীর কথা আর সুরের ১৯টি গান। ১৯৭১ থেকে ১৯৯০। শুরু ‘ও আলোর পথযাত্রী ( মান্না দে, সবিতা চৌধুরি ও অন্যান্য)দিয়ে। শেষ হয়েছে সলিল কন্যা অন্তরা চৌধুরীর গাওয়া ‘এমন সঘন বরষায়’ ধ্রুপদী গানটি দিয়ে। এই গানটা এই প্রথম শোনা আমার। এই আয়োজনে কিশোর কুমারের গাওয়া একটা গল্পগান আছে এক রাখালকে নিয়ে। যে বন ছেড়ে শহরে যায়, যার বাঁশিতে সুর ছিল কিন্তু সে শহরের মানুষের ভাষা জানত না। তাই রাজকন্যার প্রেম পেয়েও তা গ্রহণ করতে পারেনি। ফিরে গিয়েছে বনে। সাগর সেন মানেই অল্প কিছু রবীন্দ্র সঙ্গীত, ভীষণ জনপ্রিয়। তাকে দিয়ে সলিল গাইয়েছেন ১৯৮০ সালে ‘কী হলো চাঁদ কেন? সবমিলিয়ে সলিল চৌধুরী আর নষ্টালজিয়াতাড়িত বাঙালি মিলে মিশে একাকা হয়ে যেতে পারে যেকোনও সময়।
ছবিঃ গুগল
No Comment! Be the first one.