
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বের হয়ে গেলাম। পাহাড়ি উঁচু রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে বুক ধড়ফড়। সকালের মুসৌরী শহর টা অনেক সুন্দর ,বর্নিল। ফলের দোকান পেয়েই আলুবোখারা আর চেরি কিনে হাঁটতে লাগলাম। একটা দোতালা রেস্টুরেন্ট তার ছাদটা পুরো ফুলেফুলে ভরা। নানা বর্নের রঙিন সব ফুল ফুটে আছ। সেখানে ছবি তুললাম। তারপর সামনেই বিশাল এক হোটেল নাম ‘মোজাইক’। রুফটপে আছে স্পা। রুফটপের টেরাসের নাম ‘চারকোল বার এন্ড গ্রিল’ সেখানে কফি আর কেক খেয়ে ফিরলাম হোটেলে। লাঞ্চ সারলাম সামনের মল এলাকায়। ফিরে এসে হোটেলের পাশেই একটা মিষ্টির দোকান। সেখানে সিঙারা,লুচি,জিলাপি আরও নানারকম মিষ্টি । একটা মিষ্টি ছিলো স্থানীয় ভাষায় মালু পাতা দিয়ে মোড়ানো সন্দেশ। ভীষণ সুস্বাদু। জিলাপি ,মিষ্টি ,সিঙারা সবাই পেট পুরে খেলাম। অথচ খানিক আগেই সবাই লাঞ্চ করে ফিরেছি। এতোই মজা গরম গরম জিলাপি যে সবাই পাগলের মতো খাচ্ছিলাম। ফিরে এসে রেস্ট নিয়ে আবার গেলাম সেই মোজাইক হোটেলের রুফটপের টেরাসে।
অপরূপ সূর্যাস্ত উপভোগ করলাম । চাঁদ উঠলো তার সমস্ত আলো ছড়িয়ে। চারপাশ টা মায়াবী আলোর বন্যায় ভাসতে লাগলো। স্যুপ, কাবাব কফি খেয়ে ফিরলাম হোটেলে। কিছুক্ষণ পর আমি মেঝো ভাই আর শিল্পী ভাবী বের হলাম শপিংয়ে ।এবার। শিল্পী ভাবীকে হারিয়ে ফেললাম। দু’জন টুকটাক কেনাকাটা করে ফেরার পথে আবার শিল্পী ভাবী কে পেলাম। তখন ১০ টার উপর বেজে গেছে। এসে দেখি সবাই ডিনার টেবিলে। বকা খেলাম রাজু ভাইয়ের। কারণ ডিনার টাইম শেষ হয় ১০ টায়। তাড়া করে খেয়ে নিলাম অল্প কিছু। বলা হলো যেদিকেই যাই রাত ১০ টার আগে এসে ডিনার করতে হবে। আচ্ছা বলে পালিয়ে এলাম। ফ্রেশ হয়ে আবার সেই হোটেলের পেছনে হেঁটে যেয়ে বসলাম। বেশ ঠান্ডা ছিলো। খানিক বসেই চাঁদের মায়াময় আলোকে বিদায় দিয়ে ফিরে এলাম রুমে। পরদিন ভোরে উঠতে হবে। বাস নিয়ে সাইটসিন দেখতে যাবো।
যথারীতি পরদি নাস্তা সেরে আমরা বের হয়ে গেলাম। পাহাড়ি রাস্তা হেঁটে বেশ কিছুদূর যেয়ে দাঁড়ালাম রোডের সামনে । বাস চলে এলো। আমরা উঠে বসলাম। উদ্দেশ্য কেম্পটি ফলস দেখা আর পাহাড় দর্শন।
মুসৌরীতে আরো রয়েছে মিস্ট হ্রদ,পৌর উদ্যান,ভট্ট জল্প্রপাত, ঝড়িপানি জল্প্রপাত ,জ্বালাদেবী মন্দির ,বেনোগ বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য।
পাহাড়ের অসীম সৌন্দর্য আর মেঘের সফেদ রঙের খেলা দেখে চলছি…. মনে পড়ে গেলো সেই গান…
‘পরদেশী মেঘরে আর কোথা যাসরে
বন্ধু ঘুমিয়ে আছে ,দে ছায়া তারে
আয়রে মেঘ আয়রে।’
আবছা আলো, আদর মাখা ভোর ,মেঘলা আকাশ ,মাতাল বাতাস প্রগাঢ় – গন্ধ ভরা তোর।
আমি যেনো শুধু জমিয়ে রেখেছি এই পাহাড়ের সঙ্গে সমস্তটা নিজ বুকের ভেতর। ওগো পাহাড় তুমি শুষে নিও আমার সব অভিমান।
আনন্দ অনেক বেশী গভীরে
মুহুর্তরা রন্ধ্রে রন্ধ্রে জীবন্ত
নি:শ্বাসের মতোই বাস্তব সত্য……….
তবু পুরোটাই যেনো এক অলীক স্বপ্ন।
আবেগ লুকিয়ে ক্ষানিকটা মৌনতার পাখামেলা।
মেঘ মল্লারে ভেসে আসে কিছু আদ্র সুখের মায়াবী ঘ্রাণ।
সোনামাখা রোদ্দুর খেলা করে চারপাশে।
ভুলে ভরা জীবনটাকেও ভালোলাগে বিষন্ন সুন্দর।
কখন একটু ঝিমিয়ে পড়েছি। আমাদের সঙ্গের ক’জন নেমে গেলো কেম্পটি ফলস দেখতে। আর আমি রাজু ভাই, স্বপন, মেঝো ভাই, মনির ভাই রয়ে গেলাম বাসে। কেম্পটি ফলসের কাছেই আমরা যেয়ে নামলাম অসাধারণ সুন্দর একেবারে পাহাড়ের কোল ঘেষে একটা কফি শপে। যেখান থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য পুরোটাই দেখা যায়। মুগ্ধ হয়ে গেলাম পাহাড় আর সবুজের মিশেলে ঘেরা দৃশ্যপট উপভোগ করে। হলুদ রঙ করা কফিশপ টা অনিন্দ্য সুন্দর । স্বপন গান ধরলো…‘জীবনের গল্প আছে বাকী অল্প।’ সেই পরিবেশের সঙ্গে গানটা যেনো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। একটা অন্যরকম আবহ সৃষ্টি করে দিলো। কফি খেলাম, নিঃসন্দেহে খুব ভালো কফির স্বাদ। রাজু ভাই বলছিলো, ‘এমন পাহাড়ি জায়গায় এই কফির দাম ১০০ ডলার হলেও অবাক হবার কিছু ছিলোনা।’ এরপর হৈ হৈ করে বাকী সদস্যরা এসে যোগ দিলো। তারাও মহা খুশী সুন্দর কেম্পটি ফলস দেখে এসে। রোপওয়ে করে ফিরে এসেছে। আমাদের বলছিলো, আমরা মিস করেছি। জানিনা হয়তো মিস করেছিলাম কিন্ত তখন আমার কাছে এই মনোরম পরিবেশে পাহাড়কে ঘিরে কফি শপটাই স্বর্গের মতোই স্বর্গীয় লাগছিলো ।
সেখান থেকে ফিরে বাসে উঠে লাঞ্চের জন্য রেস্টুরেন্ট খুঁজছি। পেয়ে গেলাম মনের মতো রেস্টুরেন্ট । ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। গল্প আড্ডায় যখন খাওয়া শেষ হলো তখন হঠাৎ প্রচন্ড বাতাস আর মেঘ কালো করে বৃষ্টি নামলো। সে এক অভাবনীয় ভালোলাগার বাকরুদ্ধ মুগ্ধতা। সবাই নিমগ্ন হয়ে বৃষ্টি কে অনুভব করছে , যেনো আর ফিরে না গেলেই ভালো হয়। এক সময় বৃষ্টি থেমে গেলো। চারপাশে আলো কমে গিয়ে মায়াময় এক পরশে ছেয়ে দিলো মন।
সূর্য রক্তিম হয়ে ঢলে পড়ে,আমার শুকিয়ে যাওয়া আবেগে ঝলমলে রোদ হাসে । ছিপি খোলা মদের গন্ধে অনেকে মাদকতা পায়,আর আমি পাগল হই পাহাড়ি বাতাস আর ফুলের মৌতাত বুনো গন্ধে।
ফিরে আসি লোকালয়ে…….!!!
আবার মিষ্টির দোকানে চা মিষ্টি খেয়ে হোটেলে ফেরা……
রাতে রাজু ভাইয়ের রুমে ভরপুর খাওয়া ,স্বপনের সুন্দর গান। মনির, ইমরান,তারিক ভাইয়ের নাচ আর মুখরিত আড্ডায় শেষ হলো মুসৌরীর শেষ রাত্রি !!!
‘এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে
অজানা হাজার কত কাজের ভীড়ে
ছোট্ট বেলার শত রঙ করা মুখ
সুর তোলে আজও এই মনকে ঘিরে”
পরদিন সকালে মুসৌরীকে বিদায় দিয়ে চলে এলাম দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে রাজধানী দিল্লীর Hotel EROS ( নেহেরু প্লেস) এ।
দিল্লীর গল্প নাহয় অসমাপ্তই থেকে গেলো ,যেনো খানিকটা রবি ঠাকুরের ছোট গল্পের মতোই…..!!!
(শেষ)