
আমাদের উদ্দেশ্য দিল্লীর “সাত্যে ফেয়ারে”(SATTE)অংশগ্রহণ। সরাসরি মেলায় অংশগ্রহণের আগে বেড়ানোর জন্য পছন্দ করা হলো উত্তরা খান্ডের ‘মুসৌরী’ নামক সেই বিখ্যাত পাহাড়ি উপত্যকার। মনে মনে স্বস্তি সেখানে অনেকটা ঠান্ডা পাবো। ১৪ই মে নির্দিষ্ট সময়ে বিডি ইন বাউন্ডের প্রেসিডেন্ট রাজু ভাইয়ের নেত্রিতেৃ সফরকারী সদস্যরা পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্টে। সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে। সব ফর্মালিটি শেষ করে লাউঞ্জে বসলাম সবাই। যে যার মতো খাচ্ছে,ছবি তুলছে,গল্প চলছে। সঠিক সময়ে আমাদের উড়োজাহাজ যাত্রা শুরু করলো দিল্লীর উদ্দেশ্যে। দিল্লী আড়াই ঘন্টার পথ। পৌঁছালাম। লাগেজ নিয়ে বাইরে যখন বের হয়ে এলাম, মনেহলো একটা আগুনের হলকা মুখে এসে লাগলো। সম্ভবত ৪৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিলো। কোনোরকম হেঁটে আমাদের জন্য অপেক্ষারত বাসের কাছে গেলাম। প্রখর রোদকে উপেক্ষা করে সেখানে উষ্ণ অভ্যর্থনা দিতে দাঁড়িয়ে ছিলো দিল্লী ট্যুরিজমের দিকপাল শৈলেন
কৌশল্য’দা এবং কার্তিক’দা। ফুলের মালা,মাফলার আর ঐতিহ্যবাহী পাগড়ী দিয়ে বরন করে নিলেন সবাইকে। এই অসাধারণ মুহুর্তকে ভিডিও ধারণ করে রাখলেন লাইভ মনির ভাই আর যে যার ক্যামেরায় যতটুকু সম্ভর পেরেছেন। কুশল বিনিময় করে বাসে উঠে বসলাম। চেকপোস্ট এলো।কার্তিক’দা সবাইকে মাস্ক পড়তে বললেন ,নতুবা ৫০০ রুপী জরিমানা দিতে হবে। মনের বিরুদ্ধে মাস্ক পড়তে বাধ্য হলো সকলে। শৈলেন’দা তখন চলতি বাসে আলুবোখারা বিতরণ করলেন। মজা করে খাচ্ছি সবাই। বলা হলো ঘন্টা দেড়েক পরেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে, সেখানে লাঞ্চ হবে। রাজু ভাই বললেন, না আরো পরে লাঞ্চ করবো কারণ সবাই প্লেনের খাবার খেয়ে ক্ষুধামুক্ত। বাস চলতে লাগলো অবারিত সবুজ গাছ আর প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে। দোওয়ারকা যখন এলো, স্বপন বললো এখানেই আমি ট্রিটমেন্টের জন্য থেকেছি প্রায় একমাস। সবাই জায়গাটা উঁকি দিয়ে দেখছে। দিল্লী গেইট পাড় হয়ে বাস এগিয়ে যাচ্ছে। তারপর মিরাট বাইপাসের সামনে বাস থামানো হলো। সেখানে বিগবাইট নামের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অর্ডার হলো। সবাই তখন ক্ষুধার্ত। ভাত, মুরগী, খাসীর মাংস, সব্জি, মাখানি ডাল দিয়ে খাবার সারলাম বেশ মজা করে।
আমার মনেমনে ইচ্ছে এক্টু মিষ্টি যদি খাওয়া যেতো। অভিকেই বললাম চুপিচুপি। সে বললো মিষ্টির চেহারা ভালোনা। দমে গেলাম। কিন্ত ইমরান ভাই এসে বলছে গোলাপজামুনটা ভালো, কে কে খাবেন? মনেমনে কিযে খুশী হলাম। মিষ্টিটা অসম্ভব মজার ছিলো,ভেতরে পেস্তা বাদাম। চেহারা যাই হোক খেতে দারুণ স্বাদ। রসনা তৃপ্তি করেআমরা কিছুটা রিলাক্স মুডেই রেস্টুরেন্টের পেছনে গেলাম দেখতে। সুন্দর ভিউ। সেল্ফি তুলছে রাজু ভাই। কিন্ত ভালো আসছেনা রোদের জন্য, কিছুটা বিরক্ত। তখন আমি বললাম,আমার ক্যামেরা ভালো এটা দিয়ে তুলুন। ব্যাস ক্লিক ক্লিক করে কয়েকটা সেল্ফি তুলে নিলাম রাজু ভাই আর আমরাও। আবার দীর্ঘ যাত্রা। প্রায় ৮ ঘন্টার একটা পথ। এরপর হাইওয়ে ধরে মোজাফফরাবাদ অতিক্রম করে দু’তিন ঘন্টা পর চা বিরতির জন্য নামি দেরাদুনের ঠিক আগে ছোট্ট পরিসরের একটা ধাবায়। তখন সন্ধ্যা। চা ,পেয়াজু, মশলা মাখানো ভুট্টো তারপর আইসক্রিম খেয়ে নিলাম।। খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে আড্ডা। রাজু ভাইয়ের হালকা হুংকারে সবাই আবার যেয়ে উঠলাম বাসে। রাতের আকাশ ঝলমলে।বিরাট এক চাঁদ ছড়াচ্ছে অপরূপ জোছনা। বৌদ্ধ পূর্নিমার অসাধারণ রাতকে ছুঁয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি…..
উত্তরাখান্ডের রাজধানী বিশাল আয়তনের জাকজমকপূর্ণ শহর দেরাদুনের সৌন্দর্যকে চোখ মেলে উপভোগ করছি। এই দেরাদুন বাসমতি চালের জন্য বিখ্যাত। তারপর ই চলে গেলাম হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উপরে ওঠার উঁচুনিচু রাস্তায়। চারপাশে সারিসারি ট্যুরিস্ট স্পট ও চমৎকার সব রিসোর্ট ।ফলের দোকান, বেশকিছু দোকানে পন্যের সমাহার। উঁচু গাছগুলোকে আলো আঁধারিতে অপার্থিব সুন্দর লাগছিলো।
এরপরে বাস আবার থামলো। কেউ কেউ ওয়াশরুমে যাবে। আমরা ক’জন আর নামিনি। ফিরে এসে তারা যে ভয়াবহ টয়লেটের বর্ননা দিলো,তাতে করে নামিনি ভাগ্য ভালো। শিল্পী ভাবীতো আর একটু হলে বমি করে ফেলতো। এই বাইরোডে জার্নির একটা বড় আতংক আমার টয়লেট। টয়লেট ক্লিন না হলে অসুস্থতা অনুভব করি। যাইহোক….
রাত আনুমানিক ৯.৪০ আমরা পৌঁছে গেলাম মুসৌরী। অনেক উঁচু প্রায় সাড়ে ছয় হাজার উচ্চতায় আছি আমরা। মুসৌরী হলো ভারতের উত্তরাংশে অবস্থিত উত্তরাখান্ড রাজ্যের রাজধানী দেরাদুনের একটি শৈল শহর ও পৌরবোর্ড।
মুসৌরী শৈল শহরটা সমুদ্রতল থেকে মোটামুটি ১৮৮০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এর উত্তর -পূর্ব দিক বরাবর রয়েছে হিমালয় তুষার শৃঙ্গ। দক্ষিনে রয়েছে দুন উপত্যকা এবং শিবালিক পর্বত শ্রেনী। মনোরম দৃশ্যের জন্য মুসৌরীকে পর্বতের রানী বলে আখ্যায়িত করা হয়।
সবাই ভীষণ ক্লান্ত। কিন্ত বাস হোটেল অব্দি যেতে পারবেনা। সবার লাগেজ টেনে নিতে হবে। স্বপন অবস্থা বুঝেই লাগেজ দুইটা টেনে হাঁটা শুরু করে দিলো। তাঁর হাঁটার অভ্যাস আছে। জান বের হলো আমি সহ বেশ কয়েকজনার। প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে ঢালু পথে নেমে হোটেলের দেখা পেলাম। আহা…. শান্তি !!!
রাজ্যের ক্লান্তি সবাইকে মুষড়ে দিয়েছিলো। রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে নেমে গেলাম। খেয়ে প্ল্যান হলো আগামীকাল আর সাইট সিন নয়। রিলাক্স টাইম কাটাবে সবাই। আশেপাশেই পায়ে হেঁটে ঘুরবে যে যার ইচ্ছেমত । তারপর বেশীর ভাগ মানুষ রুমে চলে গেলো। আমরা ক’জন হোটেলের পেছনে চলে গেলাম। পাহাড় ঘেষে অপূর্ব একটা বসার জায়গা। চারপাশ মুক্তো ছড়ানো আলোকিত চাঁদোয়ার মতো ঝিকমিক আলো দেরাদুন ভ্যালী কে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলেছিলো। দোলনায় দুলে সে দৃশ্য মনের সব ক্লান্তি দূর করে দিয়েছিলো। ঠান্ডা হিমেল বাতাসে শীতের আমেজে বেশীক্ষন আর বসে থাকা গেলোনা, ফিরে চল্লাম হোটেল রুমে…..
গভীর ঘুম হলো সে রাতে !!! (চলবে)