ইংরেজীতে ‘কমফোর্ট ফুড’ বলে একটা শব্দ আছে, যা দিয়ে সেই সমস্ত খাবারকে বোঝানো হয় যা খেতে ভালো লাগে, যেসব খাবার শারীরীক বা মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়, যা বানানো এবং খাওয়া সহজ, সহজপাচ্য। এইসব খাবারে সাধারনত কার্বোহাইড্রেটের পরিমান বেশী থাকে। চিকেন স্যুপ বোধহয় আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় কমফোর্ট ফুড, ম্যাকরনি অ্যান্ড চিজ, গ্রিল্ড চিজ স্যান্ডউইচ অ্যান্ড টম্যাটো স্যুপ, ফ্রাইড চিকেন অ্যান্ড ওয়াফল; এসব-ই কমফোর্ট ফুডের তালিকায় রয়েছে। অনেক বছরে অনেক দেখে, বন্ধুদের অনেকের কথা শুনে শুনে বুঝতে পেরেছি, কমফোর্ট ফুডে ‘ফুড’এর চাইতে ‘কমফোর্ট’ এর পরিমাণ অনেক অনেক বেশী থাকাটা আবশ্যিক। বেশীর ভাগ সময়-ই সবাই তাদের কমফোর্ট ফুডের কথা বলতে গিয়ে বলবে, জ্বর হলে বা শরীর খারাপ হলে মা এটা বানিয়ে দিতেন। অথবা, এটা ছিলো আমাদের ক্রিসমাস ডিনারে মাস্ট হ্যাভ…। এইসব খাবারের সঙ্গে শৈশব, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত এমন কিছু স্মৃতি মিশে থাকে, সেসব খাবার খেলে মন ভালো হয়ে যায়। আমেরিকায় এতো বছর থাকতে থাকতে খুব শীতের রাতে একবাটি গরম গরম স্যুপ আর ব্যাগেট, সামারে ঠান্ডা চিকেন সাল্যাড স্যান্ডউইচ আমার কমফোর্ট ফুডের তালিকায় জায়গা করে নিলেও, মন ভালো করে দেয়া খাবার মানেই শৈশব আর মায়ের রান্না করা সব পদগুলো। আর বাঙালির কমফোর্ট কিসে, সেটিও সহজেই অনুমেয়…।
গোটা সপ্তাহ রান্না করার সময় পাইনি, বছর শেষের নানা কাজ, মিটিং…। গত সপ্তাহের লেফট ওভারের সঙ্গে মেয়েদের জন্য বানানো বেকড স্যামন, গ্রিল্ড চিকেন, টার্কি কাবার, সালাদ, স্যান্ডউইচ করে করে কেটেছে। শুক্রবার দিনটি এমনিতেই অনেক ঝামেলার, তাতে হঠাৎ করে কিছু নতুন রোগী এসে পরায় নোট জমে গেলো অনেক গুলো, শেষ করতে করতে রাত্রি ন’টা। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত, তাই আরও বেশী করেই যেন কমফোর্ট চাই কিছুটা শরীর এবং মনের…। মাছের ঝোল আর ধোয়া ওঠা গরম ভাত ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারছিলাম না…।
বরকে আগেই মাছ নামিয়ে থ করতে বলে রেখেছিলাম, কাজ থেকে ফেরার পথে সুযোগ খুঁজে আমিশ ফার্ম থেকে সদ্য তোলা বাঁধাকপি, ফুলকপি, শালগম এসব নিয়ে এসেছিলাম। রান্না করার সময় পাবো কিনা জানতাম না যদিও। বর বলছিল রান্না করার আর প্রয়োজন নেই, রাতটা আজ ম্যানেজ করে নিতে। কিন্তু মন চাইছে, এর চেয়ে বড় প্রয়োজন আর কি হয়! কালোজিরে ফোঁড়নে খোসাসহ ছোট আলু দিয়ে কোরাল মাছের ঝোল আর জিরে, এলাচ ফোঁড়নে শীতের বাঁধাকপি ভাজা রান্না যখন শেষ করেছি তখন সাড়ে রাত দশটা। পেয়াজ ছাড়া শুধু হলুদ-মরিচ-ধনে-জিরার গুড়ো মেখে কষিয়ে জল দিয়ে ফুটিয়ে নামানোর আগে উপরে সামান্য ভাজা মশলার গুড়ো ছড়িয়ে দেয়া মাছের ঝোলের চিরচেনা ঘ্রাণে সারা সপ্তাহের ক্লান্তি নিমেষে উধাও…।
এরপর রাত জেগে এডি রেডমেইন এর ‘দ্য থিওরি অব এভ্রিথিং’ এবং ‘মাই উইক উইথ ম্যারিলিন’ দেখে যখন ঘুমাতে গিয়েছি, তখন রাত প্রায় তিনটে। এতো পরিশ্রম আর ক্লান্তির পর রাত জেগে মুভি দেখার কোন প্ল্যান ছিলোনা। কিন্তু উইকএণ্ড কল ফ্রি.. আর সেই যে কমফোর্ট! সারারাত জেগে মুভি দেখতে পারাটাতেও কেমন যেন একটা কমফোর্টিং ব্যাপার আছে। হয়তো এই দায়িত্ব-কর্মে ভরপুর দুনিয়ায় রাতের ঘুমটা, সকালের ওঠাটাও নিয়ম মেনে করতে হয় বলে, মাঝে মাঝে একাএকা সারারাত জেগে মুভি দেখে নিয়ম ভঙ্গ করে সকালে দেরী ওঠার মধ্যেও কেমন এক আশ্চর্য প্রশান্তি লেপটে থাকে, স্কুলের কথা, পরীক্ষার কথা ভুলে সারারাত জেগে কাঁথার আড়ালে লুকিয়ে উপন্যাস পড়ার দিনগুলোর মতো।
ছবি: লেখক ও গুগল