রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে কুচবিহারের রানি ভূতের গল্প শুনতে চেয়েছিলেন। রানির অনুরোধ রাখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে পোড়ো বাড়ি,অন্ধকার, কঙ্কালের হাড়ের খটখট শব্দ মিলিয়ে মণিমালিকার গল্প শুনিয়েছিলেন। ‘মণিহারা’ গল্পের মূল বিষয়টাই ছিলো আলৌকিক কাহিনির হাতছানি। রবীন্দ্রনাথ কি ভূত বিশ্বাস করতেন? একেবারেই না। কিন্তু তিনি গল্পে ভৌতিক রসের শিহরণ তৈরি করেছিলেন। পশ্চিমা সাহিত্যে এ ধরণের গল্পের একটা নাম আছে-গথিক। গথিক গল্প কী? সবটাই কি ভূতের ভয়ের গা ছম ছম করা অনুভূতি? কিছু অনির্দিষ্ট বিষয় আর সংশয় মিলিয়ে পাঠককে ভাঙাচোরা কোনো প্রাচীন বাড়ির কাঠামোতে নিয়ে গিয়ে ভয়ের অনুভূতির সঙ্গে জুড়ে দেয়া? বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পের আগে গথিক গল্পের কোনো অবস্থান তেমন ভাবে গড়ে ওঠেনি। স্থাপত্যশিল্পের একটি বিশেষ ধারার নাম হচ্ছে গথিক। গথিক স্টাইলে গড়ে ওঠা মধ্যযুগের দূর্গ, প্রাসাদ বা এসবের ধ্বংসাবশেষ অষ্টাদশ শতাব্দীতে লেখকদের রোমান্টিক কল্পনায় হয়ে উঠেছিলো গথিক গল্প। সেই সুপ্রাচীন ভগ্ন ঘরবাড়ি, দূর্গের ভিতরে ছায়াময় ঘরের ভিতরে অচেনা অন্ধকার লেখকদের গল্পে উঠে আসে। এ ধরণের গল্পের পরিচয়পত্র লেখা হয় গথিক গল্প হিসেবে।
ভূতের কল্পনা আছে, ভয় আছে। কিন্তু সরাসরি ভূতের দেখা মেলে না সেসব গল্পে। ব্রাম স্টোকার সাহেবের ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসটিও এ ধরণের গথিক গল্পের কাঠামোতে ডালপালা মেলেছিলো। এই গথিক কাহিনিতে শুধু অশরীরী উপস্থিতি নয়, কাউন্টের দূর্গ, সাদা গোড়ায় টানা গাড়ি, পথের সরাইখানা কাহিনির ভীষণ এক আবহ নির্মাণ করেছে। এই একই আবহ তৈরি করা হয়েছে ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ উপন্যাসেও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে কিশোর বয়সে শাহীবাগ প্রাসাদে বসবাসের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করেন কাহিনির আবহ নির্মাণে।
বাংলা সাহিত্যে নারী লেখকদের কলমে গথিক গল্পের এ ধারা তেমন বিস্তার লাভ না করলেও পাশ্চাত্য দেশের সাহিত্যে নারীদের এ ধরণের কাহিনি রচনায় যথেষ্ট প্রধান্য তৈরি হয়েছে। মেরি শেলী, এমিলি ব্রন্টি, দিফেন দ্যু মরিয়ারের নাম ঝট করেই মনে চলে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে এই ঘরানার কাহিনি রচনায় নারী লেখকদের ভিড় লক্ষ্যণীয়।বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর এই ধারার গল্প সবচাইতে বেশি লিখেছেন সত্যজিৎ রায়।
সাম্প্রতিক সময়ে যারা সাহিত্যের এই ঘরানায় লিখছেন তারা মনে করেন, সেই আগের আদিভৌতিক গল্প এখন পাল্টে গেছে। এখন কল্পনায় নয়, বাস্তবেও তেমনি এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে অতিমারি, জীবনের সংকট, যুদ্ধ আর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ধ্বস। এখন বাস্তব পরিস্থিতির ভূতই লেখকদের তাড়িয়ে ফিরছে।
প্রাণের বাংলা ডেস্ক
তথ্যসূত্রঃ বঙ্গ দর্শন পত্রিকা, দ্য গার্ডিয়ান
ছবিঃ গুগল