রহস্য গল্প বা গোয়েন্দা কাহিনি যাই বলি না কেন এই শাখাটিকে সাহিত্যের মূল ধারায় নিয়ে আসার পেছনে দু’জন লেখক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এদের একজন স্যার আর্থার কোনান ডয়েল অন্য জন আগাথা ক্রিস্টি। তাদের সৃষ্টি দু’টি গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমস আর এরকুল পোয়ারো গোয়েন্দা গল্পকে নিয়ে এসেছে সাহিত্যের মূল ধারায়।গোয়েন্দা গল্পের পাঠকদের কাছে এই দুই গোয়েন্দা প্রবর এখনও যেন বাস্তব পৃথিবীর দুই চরিত্র।
১৯৭৫ সালের ৬ আগস্ট ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম ‘ পত্রিকার প্রথমপৃষ্ঠার নিচের দিকে খবর ছাপা হলো যার শিরোনাম ছিলো-‘এরকুল পোয়ারো ইজ ডেড;ফেইমড বেলজিয়ান ডিটেকটিভ’। খবরটা চমকে দেয়ার মতোই। সেই প্রথম সাহিত্যের একটি কাল্পনিক চরিত্রের মৃত্যু সংবাদ প্রকাশিত হলো এমন এক বিখ্যাত পত্রিকার প্রথম পাতায়!এ বছর গোয়েন্দা কাহিনির অমর লেখক আগাথা ক্রিস্টির এরকুল পোয়ারো ১০০ বছর অতিক্রম করলো।
পোয়ারোর কাহিনি নিয়ে ক্রিস্টি‘র প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে। বইয়ের নাম ছিলো-‘দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস’। বেঁটেখাটো আকৃতির গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো। আগাথা ক্রিস্টির বর্ণনায় তার মাথাটা ডিম আকৃতির। উত্তেজিত হয়ে পড়লে তার চোখে এক ধরণের সবুজ আভা খেলা করে বেড়ালের মতো। এই গোয়েন্দা খুব গোছানো স্বভাবের মানুষ। সারাক্ষণ পরিপাটি হয়ে থাকাটা তার স্বভাব। পরিচ্ছন্নতা নিয়ে শুচিবাই আছে তার। জামাকাপড়ে বিন্দুমাত্র ভাঁজ অথবা ধূলা সহ্য করতে পারে না এই গোয়েন্দা। মাঝে মাঝেই শেক্সপিয়ার থেকে ভুল উদ্ধৃতি দেন। রেগে গেলে ফরাসি ভাষায় কথা বলেন। শার্লক হোমসের চরিত্রের বাইরে এই গোয়েন্দাকে একেবারেই আলাদা ধরণের বৈশিষ্ট দিয়ে নির্মাণ করেছিলেন আগাথা ক্রিস্টি। পায়ের ছাপ অথবা সিগারেটের ছাই নয়, আগাথা ক্রিস্টি এরকুল পোয়ারোর মুখে জুড়ে দেন ভিন্ন সংলাপ-‘মস্তিষ্কের ছোট্ট ধূসর কোষগুলোকে কাজে লাগিয়েই পৃথিবীর যে কোনো রহস্যের সমাধান করা সম্ভব।’

শার্লক হোমসের যেমন টুপি তেমনি পোয়ারোর পাকানো গোঁফ এখনও বিভিন্ন ছবি আর পণ্যের গায়ে তার সিগনেচার হিসেবে শোভা পায়।শার্লক হোমসের তুমুল পাঠকপ্রিয়তার মাঝেই এই অদ্ভুত ধরণের গোয়েন্দা চরিত্রটি পাঠকদের মনের ভেতরে ঘর বানিয়ে ফেললো। কথিত আছে আগাথা ক্রিস্টি এক উদ্বাস্তু বেলজিয়ান পুলিশ অফিসারের আদলে তৈরি করেছিলেন এরকুল পোয়ারোকে। তবে এই তথ্যের সত্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। আগাথা ক্রিস্টির মাথায় গোয়েন্দা গল্প লেখার চিন্তাটা প্রথম আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে। তখন তিনি কাজ করতেন ইংল্যান্ডে একটি ডিসপেনসারিতে। টর্কি শহরে একদল বেলজিয়ান শরনার্থীকে দেখে তিনি ঠিক করেন তার গোয়েন্দাটি হবেন বেলজিয়ান। তিনি ভেবেছিলেন, অপরাধ নিয়ে যেহেতু কাজ করতে হবে তাই এই চরিত্রটি একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা হলে মন্দ হয় না। এই ভাবনা থেকেই পোয়ারো চরিত্রের যাত্রা শুরু। এই নামের প্রথম অংশ তিনি নিয়েছিলেন গ্রিক পুরাণের বীর হারকিউলিসের নাম থেকে।
প্রথম আবির্ভাবের ১০০ বছর পরেও পাঠকদের কাছে সমান জনপ্রিয় এই গোয়েন্দা চরিত্রের বুদ্ধির খেলা। গিনেস বুক অফ রেকর্ডের তথ্য অনুসারে, বাইবেল ও শেক্সপিয়ারের বিভিন্ন গ্রন্থের পরেই পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি বিক্রি হয়েছে আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা কাহিনি। এখনও এই বিক্রির রেকর্ড বজায় আছে। পোয়ারো চরিত্রকে কেন্দ্র করে ক্রিস্টি ৩০ টি উপন্যাস এবং ৫০টিরও বেশি গল্প লিখেছেন। ক্রিস্টির কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছে বহু সিনেমা। ১৯৭৮ সালে নির্মিত ‘মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ ছবিতে অভিনয় করে অভিনেত্রী ইনগ্রিড বার্গম্যান সেরা পার্শ্ব চরিত্রের জন্য অস্কার পুরস্কারও পেয়ে যান।
এই চরিত্রটিকে নিয়ে পথ চলতে চলতে হয়তো একটা সময়ে ক্লান্তি আসে লেখকের কলমে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় অন্তিম লগ্নে আগাথা ক্রিস্টি মেরে ফেলেন এই গোয়েন্দাকে। অবশ্য তখনই বইটি আলোর মুখ দেখেনি। প্রায় ৩০ বছর পর ‘কার্টেন: পোয়ারোজ লাস্ট কেস’ নামে বইটি প্রকাশিত হয়।
প্রাণের বাংলা ডেস্ক
তথ্যসূত্রঃ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, দ্য গার্ডিয়ান
ছবিঃ গুগল
No Comment! Be the first one.