শিল্পী কনকচাঁপা এবার গানের পাশাপাশি প্রাণের বাংলার পাতায় নিয়মিত লিখছেন তার জীবনের কথা। কাটাঘুড়ির মতো কিছুটা আনমনা সে
সব কথা, হয়তো কিছুটা অভিমানিও। কিছুটা রৌদ্রের মতো, খানিকটা উজ্জ্বল হাসির মতো।
একমুখী যাত্রায় অনেক দিন হলো নবযাত্রা শুরু হয়েছে। সঙ্গীতের দিকপালরা যেন কি এক অভিমানে একের পর এক চলে যাওয়ার মিছিলে সামিল হচ্ছেন।
অন্য শিল্পীদের কেমন লাগছে জানিনা কিন্তু আমি একটু একটু করে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছি।গত কয়েক বছরে আমাদের দেশের কিংবদন্তিরা চলে গেছেন যাদের সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন অথবা আমার পুরো জীবনই কাজ করেছি।তাদের চলে যাওয়ার কষ্ট আমাকে অনেক দুর্বল করে দিয়েছে। অল্প কিছুতেই কান্না পায়,শুধু মৃত্যু মনে হয়,অভিমান হয়।বলা যায় অনেকটাই বদলে গেছি আমি!এরমধ্যে লতাজীর তিরোধান , গীতশ্রীর তিরোধান যেন আমার মেরুদণ্ড ভেঙে দিলো! “লতাসন্ধ্যা”ময় সুরের আকাশ দেখেই বড় হয়েছি আমি এবং আমরা ! লতা মুঙ্গেশকর এর গান তো আমার কাছে সূর্যের আলো, এনার্জির উৎস! আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়?
একটা রেলগাড়ীর ইঞ্জিনের ভেতরের যে ভয়াবহ ডিজাইনের নানারকম যন্ত্রাংশ একের পর এক সাজানো থাকে অথচ তা অসম্ভব সুন্দর নিয়মমাফিক গোছানো থাকে যার দিকে তাকালে ভয় হয় যে আল্লাহ এর একটা স্ক্রু খুলে পড়লে আবার লাগানো যাবে তো? অথচ রেলগাড়ী কত স্মুথ ভাবে চলে যেন কোথাও কোন নিয়মকানুন নাই, সে চলছে তার নিজের তাগিদে, সন্ধ্যাজীর গানের ব্যাপারটা ঠিক তাই।কয়েক হাজার কোটি কারুকার্য ভয়াবহ অংকে ঠাসা একটা বিশাল অভিধান টাইপের বইয়ে সাজানো কিন্তু বইয়ের মালিক সন্ধ্যাজীর সব মুখস্থ! তাজ্জব!এই মানুষ দুজন যখন চলে গেলেন ঠিক তখনই আমার মনে বাজছিলো ‘ জীবন টা কিছু নয় শুধু একমুঠো ধুলো! পড়শু দিনই একটা ফুল লতাপাতার পোস্টে অযথাই এই পঙতি আমি লিখেছি।কি মনে করে লিখেছি জানিনা।
আমি রান্না করছিলাম কাঁদছিলাম
আমি গাছে পানি দিচ্ছিলাম কাঁদছিলাম
আমি কাঁদছিলাম নামাজ পড়ছিলাম তা
কেউ ধরতে পারেনি কিন্তু মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। ফোনে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে ফোন করেছি,মা সোজা জিজ্ঞেস করলেন কান্দো কেন মা! আমি বিস্মিত! মায়ের কাছে ধরা আমি খাবোই! যেমন ধরা খেয়েছিলাম চল্লিশ বছর আগে!একটা ক্যাসেটের ভেতর অসম্ভব সুন্দর সুন্দর গান! তার একটা গান “মুখ তার ঘুম ঘুম গোলাপী গাল!” গানটার প্রেমে পড়ে গেলাম! গান শুনি আর ক্যাসেট কভারের দিকে তাকিয়ে থাকি।টুলে বসে বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে ক্যাসেট হাতে কেমন অস্থির চিত্তে বসে থাকি।আমি ভাবি “গেলো মন চুরি ভরা হাটে কেউ দেখলো না?” এটা কোন কথা! এই কথা কেউ কি আমাকেই বলছে অথবা শিল্পী নিজেই! কিন্তু তা কি করে হয়! আসলে কে বলছে আমি তা জানিনা।
তারপর আরও মুশকিল এ পড়ে গেলাম যখন শুনলাম “সোনার আখরে লেখা ভুলে যাওয়া নাম!” আহা! আমি বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদি! মনে রাখার আগেই আমার নাম ভুলে যাবে! নব্য কিশোর মনের বিরহ বিলাস আর কি! আম্মা এবার এগুলো বুঝতে পেরে ভয়াবহ রেগে ক্যাসেট কেড়ে নিলেন! তাতে ওই গানগুলো প্রতি আকর্ষণ আরও বেড়ে গেলো!সেই যে আমি বাপ্পি লাহিড়ীর গানের প্রেমে পড়লাম তার থেকে নিস্তার আর পাইনি! “জীবনটা কিছু নয় শুধু একমুঠো ধুলো” এই গান মর্মে গেঁথে গেলো , আবার বৌদি গো বৌদি গো, মামার শালা পিসার ভাই এই টাইপের চটুল গানও ভালো লাগছিলো যেটা ছিলো আসলে শিল্পীর প্রতি প্রশ্রয় টাইপ ভালোবাসা। কারণ কখনও আমি এমন হালকা গান শুনতে পছন্দ করি না কিন্তু এই গানগুলোও আমার শোনার তালিকায় যুক্ত হলো।
অবশেষে আম্মা আমার কান্না এবং থমথমে অবস্থা দেখে বাধ্য হয়েছিলেন ক্যাসেটটা আমাকে ফেরত দিতে।এরপর ক্যাসেটটা যদি আবারও হারিয়ে ফেলি সে জন্য আমি স্কুল ব্যাগে লুকিয়ে স্কুলেও নিয়ে যেতাম! তাঁর গাওয়া প্রতিটি বাংলা গানের প্রতি আমার এমন পক্ষপাত!
“মনে পড়ে তুমি ছিলে আর আমি ও ছিলাম।তুমি ভালো বেসেছিলে আমি ভালোবাসা শিখেছিলাম” গানটি আমাকে বসন্তের উদাসী হাওয়ায় উড়ন্ত তুলার মতো নাস্তানাবুদ করে ছাড়তো। আমি পুঁজরা পুঁজরা হয়ে উড়ে বেড়াতাম শিমুল গাছের উচ্চতায় আর
তারপরই অশ্রু ঝরে বর্ষা নামতো কোন কারণ ছাড়াই অথচ আমার কোন প্রেমাস্পদ তখনও ছিলো না!
একজন প্রকৃত শিল্পী একজন মানুষের জীবনে,একজন শ্রোতার জীবনে এভাবেই জড়িয়ে যায়,এভাবেই মিশে যায়। যারা এভাবে মিশে নিজের উপস্থিত বিলীন করতে পারেন তিনি মহাশিল্পী। বাপ্পি লাহিড়ী তাঁর উপস্থিতির মতই বিশাল ছিলেন।
ব্যাক্তি বাপ্পি লাহিড়ীর জীবন যাত্রা সাজসজ্জা এমনকি দুর্দান্ত ডিসকো গান আমাকে কখনও টানেনি।কিন্তু উনার বাংলা গান এবং উনার কণ্ঠ, উনার স্লাইট নজাল ও হাস্কি এবং মাদকতাময় কণ্ঠের বিশেষত্ব আসলেই খুবই স্পেশাল! অনবদ্য! আমি এখনো কাঁদছি আর মনে মনে অনুরণিত হচ্ছে “জীবনটা কিছু নয় শুধু একমুঠো ধুলো চৈতী বাতাসে ওড়া শিমুলেরই তুলো!”
হে কিংবদন্তি, আপনার একমুখী যাত্রা সহজ হয়ে যাক।আপনার একান্ত ভক্তের এই চাওয়া স্রষ্টার কাছে।
ছবি: গুগল