ব্রাজিলে ১৯৪০ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সামরিক সরকার ১৬টি সিনেমা নিষিদ্ধ করেছিলো। তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ায় ১৯৬৬ থেকে ১৯৮৯ সালে কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থায় ২৩টি সিনেমা নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। জার্মানীতে হিটলারের আমলে প্রদর্শনের অনুমতি বাতিল হয়েছিলো ১৬ টি সিনেমার। এই সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচাইতে বেশি সময়ের জন্য নিষিদ্ধ ছিলো ‘অল কোয়ায়েট ইন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। সেই সময়ে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক এরিক মারিয়া রেমার্কের এই উপন্যাসটিও নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। একই ভাবে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু বন্ধ করে দিয়েছিলো চার্লি চ্যাপলিন অভিনীত ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ ছবির প্রদর্শনী। অশ্লীলতার দায় মাথায় নিয়ে ৩০ বছর ইতালী, দক্ষিণ কোরিয়া, পর্তুগাল ও চিলিসহ পৃথিবীর আরও অনেকগুলো দেশে নিষিদ্ধ ছিলো ‘লাস্ট ট্যাংগো ইন প্যারিস’। বিপ্লব ঘটে যাবার আশংকায় ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সের্গেই আইজেনস্টাইন পরিচালিত ‘ব্যাটেল শিপ পটেমকিন’-এর প্রদর্শনী।
রাজনীতি, স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু, অসহিষ্ণুতা আর তথাকথিত সামাজিক নৈতিকতার ধুয়ো তুলে বিভিন্ন সময়ে নিষেধের খড়গ নেমে এসেছে সিনেমার ওপর।মানুষের মুক্ত সাংস্কতিক চর্চার ওপর, চিন্তার ওপর আঘাত হানার জন্যই বাঁধা হয়েছে নিষেধের কাঁটাতার।
এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো সেই নিষিদ্ধ সিনেমা নিয়ে ‘নিষেধের যতো সিনেমা’।
সিনেমা যেমন রাজনৈতিক কারণে নিষিদ্ধ হয়েছে তেমনি নিষিদ্ধ হয়েছে অশ্লীলতার দায় মাথায় নিয়ে। চার্লি চ্যাপীরন অভিনয় করেছিলেন ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ সিনেমায়। সেখানে ব্যাঙ্গের চাবুকে তছনছ করা হয়েছিলো অ্যাডলফ হিটলারকে। এই সিনেমাটি জার্মানীতে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়ে ছিলো।দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসনের লৌহ কপাটের অন্তরালে আটকে ফেলা হয়েছিলো চ্যাপলিনের এই অমর সৃষ্টিকে।
১৯৭৩ সালে তৈরী হয় আরেক সমালোচিত সিনেমা ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’। অভিনেতা ছিলেন মার্লন ব্রান্ডো। ‘অতিমাত্রায় যৌনতা নির্ভর’ এই অভিযোগে ‘লাস্ট ট্যাংগো ইন প্যারিস’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ৩০ বছর নিষিদ্ধ ছিলো। শারীরিক মিলনের সময় মাখন ব্যবহার করায় ইতালি ও স্পেনে ছবিটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়। তাদের বক্তব্য ছিলো, খাদ্যবস্তু সঙ্গমের সময়ে এভাবে ব্যবহার করাটা শোভন নয়।
এই ছবিতে অবাধে যৌনতা ব্যবহারের অভিযোগ তোলা হলেও এখন বিশ্বের দশটি সেরা ছবির তালিকায় স্থান পাচ্ছে ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’।
সিনেমা নিয়ে তুলিকালামের এই গল্প অন্তহীন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সের্গেই আইজেনস্টাইনের তৈরী ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ দীর্ঘ সময় ধরে ফ্রান্স, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও স্পেনে নিষিদ্ধ ছিলো। সমাজতান্ত্রিক মতবাদ ছড়ানো ও জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সূচনার কাহিনি তুলে ধরে এই সিনেমা বিপ্লবে উস্কানি দিতে পারে এই আশংকায় বন্ধ করা হয় এর প্রদর্শনী। ১৯৫৮ সালে ইংল্যান্ডে এই সিনেমাটিকে ‘এক্স’ মার্কা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।শুধুমাত্র ফ্রান্সেই এই সিনেমাটি ২৫ বছর নিষেধের বেড়াজালে আটকে ছিলো।
আরেক খ্যাতিমান নির্মাতা স্ট্যানলি কুবরিকের সিনেমা ‘ক্লক ওয়ার্ক অরেঞ্জ’ ইংল্যান্ডে ২৭ বছর ধরে নিষিদ্ধ ছিলো মারামারি আর পাশবিক ধর্ষণ দৃশ্য দেখানোর অভিযোগে। উল্টোদিকে আমেরিকায় ছবিটি ব্যাপক সাড়া ফেলে।‘ক্লক ওয়ার্ক অরেঞ্জ’ শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, ইউরোপ এবং এশিয়ার কয়েকটি দেশেও নিষিদ্ধ করা হয় অতিরিক্ত ভায়োলেন্স দেখানোর অভিযোগে।কিন্তু যারা ভায়োলেন্সের অভিযোগ তুলে সিনেমা নিষিদ্ধ করেন তারা পৃথিবীর দেশে দেশে সন্ত্রাস আর যুদ্ধ কি নিষিদ্ধ করতে পেরেছেন?
এরিক মারিয়া রেমার্কের যুদ্ধবিরোধী অসাধারণ এক উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট ইন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট।’ এই উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৩০ সালে নির্মিত হয় সিনেমা। হিটলার ক্ষমতায় বসেই নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন এই সিনেমার ওপর। নিষিদ্ধ হলো বই এবং সিনেমা দু‘টোই। ফ্যাসিবাদী জার্মানীতে ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে নিষিদ্ধ করা হয় ১৬টি সিনেমার প্রদর্শনী। ‘অল কোয়ায়েট ইন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ সিনেমাটি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানীর ক্যাপিটাল থিয়েটার হলে প্রথমবারের মতো এই সিনেমার প্রদর্শনী হয় ১৯৫০ সালে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিভিন্ন সময়ে ধর্ম আর শ্লীল-অশ্লীলের সীমা ঠিক করতে গিয়ে বেশ কিছু সিনেমা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা এখনও বহাল আছে। ১৯৫৯ সালে আরব লীগ ভূক্ত দেশগুলিতে নিষিদ্ধ করা হয় ‘বেনহার” অভিযোগ ছিলো এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন ইজরায়েলী অভিনেত্রী হায়া হারারেত। সৌদি আরবে এখনো নিষিদ্ধ হ্যারি পটার সিরিজের সবগুলো সিনেমা।একই ভাবে ইরান বন্ধ করেছে ‘পিনোকিও’ নামে শিশুতোষ ছবিটি।ইরানে ইসলাম বিরোধীতার যুক্ত দিয়ে ‘পার্সিপলিস’ নামে একটি অ্যানিমেটেড সিনেমাও নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে।ইরান বিপ্লবের অন্তরালের বহু কথা এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে। তাই সরকার নাখোশ।
প্রাণের বাংলা ডেস্ক
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
ছবিঃ গুগল