রাত্রি নামছে অরণ্যে। সেই কবেকার অতীতের অন্ধকার ভেঙে পায়ের তলায় জীবন্ত হয়ে উঠছে শুকনো পাতার রাশি, জঙ্গলে পাইথন সাপের চলাচল, বেবুনের ডাক-ঘুম ভেঙে যেন জেগে উঠছে আফ্রিকার রাত্রি। চাঁদের অস্পষ্ট আলোতে আরও গভীর হয়ে উঠছে আঁধারের রূপ। আফ্রিকা জেগে উঠছে আজও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসের পৃষ্ঠায়।
১৯৩৭ সালে প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিলো কিশোর অ্যাডভেঞ্চার। সেই যে বাংলার অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে শঙ্কর চাকরিসূত্রে পাড়ি দিলো আফ্রিকা। মোম্বাসা থেকে সাড়ে তিনশো মাইল দূরে উগান্ডা রেলওয়ের কেরানি আর স্টোরকিপার হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়েছিলো। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো, শঙ্করের গল্প হয়ে উঠলো আমাদেরই গল্প। ভালোলাগা আর এক ধরণের আচ্ছন্নতা নিয়ে ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাস পঁচাশি বছরে পা রাখলো এ বছর।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রিশের দশকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত শিশু কিশোরদের পত্রিকা মৌচাকে ধারাবাহিক ভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন উপন্যাসটি।১৯৩৭ সালে উপন্যাসের প্রস্তাবনায় তিনি লিখেছেন, ‘চাঁদের পাহাড় কোনও ইংরিজি উপন্যাসের অনুবাদ নয় বা ঐ শ্রেণীর কোনও বিদেশী গল্পের ছায়াবলম্বনে লিখিত নয়।… তবে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক সংস্থান ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনাকে প্রকৃত অবস্থার অনুযায়ী করবার জন্য আমি স্যার এইচ এইচ জনস্টন, রোসিটা ফর্বস প্রভৃতি কয়েকজন বিখ্যাত ভ্রমণকারীর গ্রন্থের সাহায্য গ্রহণ করেছি।’ তবে এই উপন্যাস লেখার কাজে বিভূতিভূষণ বিদেশী বইয়ের সহায়তা নিলেও শঙঙ্কর চরিত্রটি তার একান্ত নিজের। এই শঙ্কর, অপু, সত্যচরণ সবাই ভীষণ ভাবে রোম্যান্টিক, ভীষণ ভাবে প্রকৃতি-প্রেমিক।
নিজের কোনো লেখাতেই দেশ বা রাজনীতির কথা সরাসরি প্রকাশ করেননি তিনি। তাঁর লেখায় এই রাজনৈতিক চেতনার অভাবের দিকটা নিয়ে সমালোচনা করতে ছাড়েননি সমালোচকরা। তিরিশের দশকে খুব আলোচিত হতো গান্ধীর ডান্ডি অভিযানের খুঁটিনাটি। কিন্তু বিভূতিভূষণ অফ্রিকা নিয়ে উপন্যাস লিখে যাচ্ছেন নীরবে। শেষে অনেকের অনেক প্রশ্নের মুখে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশ কি আর সবার কাছে একই রকম? আমরা লেখকরা দেশটা খুঁজি অন্য ভাবে, আমরা জীবনের অনেক গভীরতর দেশকে দেখি— রাজনীতি তো শুধু তার ওপরের ভাসাভাসা পরত মাত্র, আর কিচ্ছু নয়।’
আসলে চাঁদের পাহাড়ে রিখটার্সভিল্ডের সেই রত্নখনির সন্ধান পাওয়ার জন্য শঙ্করের মনে যে স্বপ্ন সেটা আসলে বিকাশমান তখনকার বাঙালি সমাজের স্বপ্ন দেখারই গল্প। বিভূতিভূষণ সেই জায়গাটা ধরেই কিশোরদের মনে নতুন স্বপ্ন বোনার খেলাটা খেলেছিলেন।
শঙ্কর দেখতে পায়, ইউকা গাছের তলায় বসে আছে এক জন বুড়োমতো লোক। দীর্ঘ দিনের না-কাটা চুলদাড়ি, রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রং, বলিষ্ঠ অথচ অনাহারক্লিষ্ট বৃদ্ধ প্রস্পেক্টর আলভারেজের সঙ্গে শঙ্করের সেই প্রথম পরিচয়। জ্বর গায়ে আলভারেজ সে দিন তাকে এক অদ্ভুত হলদে হিরার খনির গল্প শুনিয়েছিলো। কাফেরদের গ্রাম আর জঙ্গল ছাড়িয়ে সেই যে অনেক দূরের ধোঁয়া-ধোঁয়া পাহাড়, সেখানেই আছে সেই নাম না জানা হিরার খনি। মানুষ বলে ওটাই চাঁদের পাহাড়। পাহাড়ি উপদেবতা বুনিপ বসবাস করে সেখানে। তাকে দেখা যায় না। কিন্তু বুনিপ মানেই হলো, সাক্ষাৎ মৃত্যু। এক বার যে সেই পাহাড়ে যায়, আর কোনও দিন ফিরে আসে না। গল্পে হারিয়ে যেতে যেতে শঙ্কর সে দিন দেখেছিলো আলভারেজের জ্বরে ঘোলা হয়ে আসা চোখ অন্ধকার স্টেশনঘরের নিভে আসা আলোতেও জ্বলজ্বল করছে!
একটা সময়ের ভিতরে, একটা সমাজের মানচিত্র নতুন ভাবে আঁকার সময়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অজানার স্বপ্নকে নড়বড়ে বাঙালি সমাজের মনের মধ্যে পতাকায় গেঁথে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর চাঁদের পাহাড়ে। সেই মাউন্টেইন অফ দ্য মুন কে দেখেছে? কেউ দেখেনি। কিন্তু অজানার স্বপ্ন ঠিকেই রয়ে গেছে আমাদের চোখেমুখে। অন্তত যারা চাঁদের পাহাড় পড়ে বড় হয়েছি তাদের মনে তো বটেই।
প্রাণের বাংলা ডেস্ক
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা
ছবিঃ গুগল