
পেছনে ফেলে আসা বিংশ শতাব্দীর যুদ্ধ, ভয়াবহতা আর গভীর অন্ধকারের এক ছবি;সত্তরের দশকে ভিয়েতনামে আমেরিকার দানবীয় যুদ্ধের এক বীভৎস দলিল। প্লেন থেকে ফেলা নাপাম বোমার আগুনে ঝলসে যাওয়া এক বালিকা নগ্ন হয়ে ছুটছে পথে। তার পরনের পোশাকটাও আগুনে পুড়ে গেছে।ভয় আর যন্ত্রণা নিয়ে সে ছুটছে বাঁচার আশায়। পিছনের দিগন্তে আগুনের কালো ধোঁয়া।
১৯৭২ সালের ৮ জুন তখনকার ভিয়েতনামের ত্রাং বাং নামের একটি গ্রামের রাস্তায় ছবিটা তুলেছিলেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-এর ভিয়েতনামী ফটোগ্রাফার নিক উএ বছর এই আলোচিত ছবিটি পঞ্চাশ বছরে পা রাখলো। ছবিটা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেতেই পৃথিবীর মানুষ কেঁপে ওঠে তাদেরই সৃষ্ট নির্মমতায়। সেই নির্মমতার একটাই নাম-যুদ্ধ।
যে বালিকাটি ৫০ বছর আগে জীবন বাঁচাতে নিষ্ঠুর পথে ছুটছিলো তার নাম ফান থি কিম ফুক। এই বালিকা আজও বেঁচে আছেন পৃথিবীতে। নাপাম বোমার আগুনে পুড়ে গিয়ে সেদিন তার মৃত্যু ঘটেনি। তার জীবন বাঁচিয়েছিলো এপি‘র সেই ফটোগ্রাফার। তাদের দু’জনের মধ্যে আজও যোগাযোগ আছে। তারা এখনও পৃথিবীর নানা মঞ্চে কথা বলে চলেছেন শান্তির স্বপক্ষে।
তখনকার সায়গন থেকে ৩০ মাইল উত্তর পশ্চিমে ফুকের গ্রাম ত্রাং বাং। ৮ জুন সকালে আমেরিকার সৈন্যদের সহযোগী দক্ষিণ ভিয়েতনামের সৈন্যরা কমিউনিস্ট গেরিলাদের হঠিয়ে দেয়ার জন্য ওই গ্রামে অবস্থান নেয়। ফুক গ্রামের আরও মানুষের সঙ্গে আশ্রয় নেয় একটি বৌদ্ধ মন্দিরে। ভয়ংকর নাপাম বোমা পেটে ঢুকিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামের কয়েকটি জঙ্গি বিমান হানা দেয় ওই গ্রামের আকাশে। তাদের লক্ষ্য, গেরিলাদের অগ্রযাত্রা রুখে দেয়া। তখন ফুক মন্দির থেকে বের হয়ে এসেছিলো বিমান দেখতে। আর তখনই অভিশাপের মতো আগুনের বোমা নেমে আসে আকাশ থেকে। নাপাম বোমা যে কোনো বস্তুর সংস্পর্শ পেলেই আগুন জ্বালায় নিপুন ভাবে। গাছপালা, মাটি, মানুষ পুড়িয়ে দেয় নির্বিকার ভঙ্গিতে। সেদিন সকালে বিমান দেখতে বাইরে আসা ফুকের শরীরওপুড়িয়ে দিয়েছিলো। আগুনের জ্বালা কমাতেই দিশেহারা ফুক ছুটছিলো রাস্তা ধরে।
উতের বয়স ছিলো ২১ বছর। আরও কয়েকটি বিদেশী গণমাধ্যমের ফটোগ্রাফারের সঙ্গে তিনিও গিয়েছিলেন যুদ্ধের ছবি তুলতে। উতের ভাষ্য অনুযায়ী, ফুক সেদিন রাস্তায় দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার করছিলো আর বলছিলো, জ্বলে যাচ্ছে, জ্বলে যাচ্ছে। উত তার ক্যামেরা ফেলে দ্রুত ফুকের ঝলসে যাওয়া শরীরে পানি ঢালার ব্যবস্থা করেন। তারপর তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যান কাছের একটা হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালে রোগী ভর্তির জায়গা নেই সেদিন। ডাক্তাররা ফুককে বলে, আরও দূরে অন্য একটা হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সেদিন উত তাদের কথা না শুনে তার সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করে ফুককে ওই হাসপাতালেই ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন। তা না-হলে ফুকের সেদিন মৃত্যু ঘটতো।
উতের সহকর্মীরা সেদিন ডার্করুমে ছবিটা দেখেই বলেছিলো, এই ছবি পুলিৎজার পুরস্কার পাবেই। তাদের অনুমান সঠিক হয়েছিলোএক বছর পরেই। সেরা খবরের ছবি হিসেবে উতের ছবি পুলিৎজার পুরস্কার পায়। ছবিটা আমেরিকার ২০টি পত্রিকায় একযোগে ছাপা হয়।
প্রাণের বাংলা ডেস্ক
তথ্যসূত্রঃ সিএনএন
ছবিঃ গুগল