
লেখক, সাংবাদিক উর্মি রহমান প্রাণের বাংলার জন্য লিখছেন দূরের হাওয়া বিভাগে জীবনস্মৃতি; ‘মনে পড়ে’। তার শৈশব, কৈশোর জীবনের বয়ে চলা পথের গল্পগুলো এই ধারাবাহিক জুড়ে থাকব। উর্মি রহমান দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করেছেন। কাজ করেছেন বিবিসি বাংলা বিভাগেও। এখন বসবাস করেন কলকাতায়।
দীপায়ন ফিরে গেলো কলকাতায় এবং তার পুরনো কর্মস্থল ‘দি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় যোগ দিলো। খুব মিস করতাম ওকে আর জয়শ্রীকে। এর মধ্যে দু’জন নতুন সহকর্মী পেলাম। সুভদ্রা ঊর্মিলা

মজুমদার এবং সাগর চৌধুরী। দু’জনেই কলকাতা থেকে। এখানে বলে রাখি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ, দু’জায়গা থেকেই রিক্রুট করা হতো। ওদের দু’জনের সঙ্গেই সখ্য হলো। যারা বাইরে থেকে অনুষ্ঠানে অংশ নিতো, তাদের মধ্যে একটি মেয়ের কথা না বললেই নয়। সামিয়া জামান ওরফে লিসা। ঢাকা থেকে লন্ডন এসেছিলো। ওর কথা শামীম চৌধুরী একদিন এসে বললো, ‘ঢাকা থেকে একটা মেয়ে এসেছে। বিবিসিতে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চায়। তোর কাছে নিয়ে আসবো?’ বললাম নিয়ে আসো। খুৃব স্মার্ট, মিষ্টি আর চটপটে মেয়ে।আমার ওকে খুব ভাল লাগলো। তাই আমার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে নিয়ে নিলাম।
প্রথম ওর জড়তা ছিলো তবে সেটা ও খুব দ্রুত কাটিয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে বিবিসি টেলিভিশনে, সম্ভবতঃ সম্পাদনা বিভাগে কাজ করেছে। আমি বিবিসি বাংলা ছাড়ার পর সেখানেও প্রযোজক-সম্প্রচারক হিসেবে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশের পাঠকরা অনেকেই তাকে চেনেন, প্রথমে একুশে টিভিতে ছিলো। পরে একাত্তর টিভিতে দায়িত্বশীল পদে থেকেছে, হয়ত এখনো আছে। তবে আমি যখনকার কথা বলেছি, তখন ওর বয়স খুবই কম ছিলো। আমার সঙ্গে ওর খুব ভাব হয়ে গেলো। অনেকটা আমার ছোট বোনের মত হয়ে উঠলো। আর একটি ছেলে বেশ অল্পবয়স থেকে আমাদের সঙ্গে অনুষ্ঠান করতো নাম অর্ণব রায়। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে পড়তো। সে-ও ছিলো ছোট ভাইয়ের মত। পরে লিসার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়। অর্ণব জাতিসংঘে কাজ শুরু করে। ওরা দু’জনে আজ আমাদের খুব কাছের মানুষ হয়ে রয়েছে। পরে নাজমা চৌধুরীও এসেছিলেন, আমাদের সঙ্গে অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। তিনি তার আগে ভয়েস অব আমেরিকার সার্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন।

সাগরকে আপাতঃদৃষ্টে গম্ভীর মনে হলেও যথেষ্টই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমাদের সবার সঙ্গে। আমি আর ঊর্মিলা, আমরা দু’জনেই ছিলাম বাংলা বিভাগের সার্বক্ষণিক নারী কর্মী। ফলে আমাদের দু’জনের মধ্যেও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হলো, যা আজও অটুট আছে। বাইরে থেকে যারা অনুষ্ঠানে অংশ নিতো, তাদের মধ্যে মুশতাক খান ছিলো। ও তখন পিএইচডি করছে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলো। পরবর্তী সময়ে প্রথমে কেম্ব্রিজ’এ শিক্ষকতা করেছে আর পরে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ বা সোয়াস’এ শিক্ষকতা করছে। মুশতাকও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠে। ওর বন্ধু হোসেন জিল্লুর রহমান ম্যাঞ্চেস্টারে পিএইচডি করছিলো। জিল্লুরকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই। তার সঙ্গেও বন্ধুত্ব হলো।
আমরা একবার জিল্লুরের বিশ্বদ্যিালয়ে গেলাম। ভাল লেগেছিলো সেইসব আড্ডা আর বেড়ানো। আরো কিছু মানুষ আসতেন, তাঁরা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, নাটক ইত্যাদিতে অংশ নিতেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী মঞ্জু বৌদি। দু’জনেই চমৎকার মানুষ। অজিত’দাকে আপনাদের অনেকে সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’ ছবিতে দেখেছেন। তপন গুপ্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মায়া সেনের ভাই। তাঁর স্ত্রী গৈরিকা’দিও ভারী ভাল মানুষ ছিলেন। এই চারজনের কেউই আজ আমাদের মধ্যে নেই। নরেশ ব্যানার্জী আমাদের সঙ্গে সংবাদ ও সাময়িক প্রসঙ্গের অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিতেন। তাঁকে অবশ্য সবাই নরি ব্যানার্জী ডাকতো। এদিকে কাজ তো পুরোদমে চলছিলো। রাতের শিফট’এ সার্বক্ষণিক সহকর্মীরা ছাড়াও ক্যাজুয়াল প্রযোজক যাঁদের বলা হতো, তাঁরা থাকতেন। সার্বক্ষণিক কর্মীদের পরেই তাঁদের স্থান ছিলো। সেখানে বিবিসির পুরনো কর্মী তালেয়া রেহমান আসতেন। সাখাওয়াত ভাই আসতেন। রাতের শিফট’এ অবশ্য আড্ডা মারার খুব একটা সুযোগ ছিলো না। কিন্তু তাঁদেও সাহচর্য্য ভাল লাগতো। রাত দু’টোর সময় ট্রান্সমিশন ছিলো। শেষ করে আমরা বিবিসির নির্ধারিত ট্যাক্সিতে বাড়ি যেতাম। একবার এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে চালকের আসনে পেয়ে খুব ভাল লেগেছিলো।

গল্প করতে করতে বাড়ি গিয়েছিলাম। অনেক নারী বিলেতে ট্যাক্সি চালান, তাঁদের মধ্যে বাঙালি নারীকেও দেখা গেছে। বিবিসিতে প্রায়ই নানা ধরনের পার্টি হতো। আমরা কাজ সেরে সেজেগুজে অংশ নিতাম। বিবিসির ভবন, তখন ছিলো বুশ হাউজ। সেখানে ছাড়াও বিভিন্ন সহকর্মীর বাড়িতেও পার্টি/আড্ডা হতো। দেশ থেকে অনেকে আসতেন। তাঁদেও কারো কারো সাক্ষাৎকার নিয়েছি বিবিসিতে। কেউ বা শুধু বিবিসি অফিস দেখার বাসনা ব্যক্ত করতো। তাঁরাও নিরাশ হয়নি। আমি আর মানসী আমার ছেলে রূপক আর ওর মেয়ে রুম্পাকে নিয়ে শিশুদের নাটক দেখেছি। সামার বা গ্রীষ্মকালে স্কুলে বেশ লম্বা ছুটি হতো তখন আমাদের মত কর্মজীবী মায়েদের একটু সমস্যায় পড়তে হতো। বাচ্চাদের কোথায় রেখে আসবো। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস তার একটা সহজ সমাধান করে দিয়েছিলো। কর্মীদের বাচ্চাদের জন্য তারা সামার প্লেগ্রুপের ব্যবস্থা করতো। রূপক আর রুম্পা তাতে অংশ নিতো। ওদের নানা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো, পার্কে বা কোনো খামারে। অনেককিছুই ছিলো শিক্ষামূলক। ওরা সেই সামার প্লেগ্রুপ খব উপভোগ করতো। সেটা শেষ হবার পর ওরা আমাদের বিভাগে এসে দু’জন কোনো খালি টেবিলে বসে ছবি আঁকতো বা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতো। তারপর আমাদের কাজ শেষ হলে একসঙ্গে বাড়ি ফিরতাম। সব মিলিয়ে বিবিসি বাংলা বিভাগের সার্বক্ষণিক কর্মী ও যারা অংশ নিতো, সবাই মিলে আমরা একটা বৃহৎ পরিবারের মত ছিলাম। একাকিত্ব কখনো কষ্ট দিতো না।