
ফারহানা নীলা
পোস্টবক্স। ফেইসবুকের একটি জনপ্রিয় গ্রুপ। এবার প্রাণের বাংলার সঙ্গে তারা গাঁটছড়া বাঁধলেন। প্রাণের বাংলার নিয়মিত বিভাগের সঙ্গে এখন থাকছে পোস্টবক্স-এর রকমারী বিভাগ। আপনারা লেখা পাঠান পোস্টবক্স-এ। ওখান থেকেই বাছাইকৃত লেখা নিয়েই হচ্ছে আমাদের এই আয়োজন। আপনারা আমাদের সঙ্গে আছেন। থাকুন পোস্টবক্স-এর সঙ্গেও।
ঘরটা স্যাঁতস্যাঁতে, ছাদের চাতাল দিয়ে উঁকি দেয় আকাশ। সাততলা বস্তির কোণাটায় রিনা আর নুরুলের সংসার। গ্রামের বাড়ীর পাট চুকিয়েছে প্রায় সাত বছর। গ্রামে তেমন কোনো কাজ নাই, খাওয়া নাই, টাকা নাই। ঢাকা শহরে বলে টাকা ওড়ে, শুধু ধরতে জানলেই হয়! নুরুল একটা গ্যারেজে কাজ করে। সারাদিন গাড়ীর লোহালক্কড় নাড়াচাড়া আর রাত হলে বসে জুয়ার আড্ডা। কামাই যা করে তার বেশী খরচ করে ঘরে আসে।
দুই ছেলেকে গ্রামে নানাবাড়িতে রেখে এসে রিনা হোটেলের রান্না করে। সকাল হতেই ঘরের রান্না শেষ করে ছোটে টিবি গেইটের হোটেলে।
রিনার জরায়ু অপারেশন হয়েছে তাও তো তিন বছর! এত রক্ত যেতো যে অসুস্থ হয়ে থাকতো সে ক’দিন। ওয়ারলেসের বেসরকারী একটা ক্লিনিকে অপারেশন হয়। কয়দিন ভারী কাজ বন্ধ ছিলো। তখন সংসারে অভাবের শেষ ছিলো না। নুরুল কোনো খরচপাতি দেয়নি। গাইনীর ডাক্তার আপা মানুষটা খুব ভালো। রিনার কাছে আধা খরচ নিয়েছিলেন। রিনা আজো মানুষটার জন্য দোয়া করে। আসলে মন থেকে চলে আসে দোয়া,আলাদাভাবে করতে হয় না।
ছোটবেলায় এগারো বছর বয়সে মাসিক শুরু হওয়ার দিন মা ত্যানা পেঁচিয়ে দিয়েছিলেন। টকটকে রক্ত দেখে রিনা খুব ভয় পেয়েছিলো। তারপর মাসে মাসেই…..
তিন বছর আর এসব ঝামেলা নেই। রিনার খুব হালকা লাগে। কিন্তু মনের ভেতরে একটা ধুকপুক থেকেই যায়।
নুরুলের ভাবগতিক ভাল লাগে না রিনার।
*
ঘরটা বেজায় আঁধার। রিনার আজকাল কেমন জানি অশান্তি লাগে,অবসাদ লাগে। ক্ষুধা পায় না। হঠাৎ করে খুব গরম লাগে,ঘাম হয় আবার শীত করে।
আজকাল নুরুলকেও সহ্য হয় না। নুরুল কাছে এলেই রিনার ভীষণ গা রিরি করে, বমি পায়। কিন্তু এসব কথা বলা যায় না। সংসারে সব কথা বলতে নেই।
ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শব্দ হলো দরজায়। ভকভক করে বাংলা মদের গন্ধ ছেয়ে যায়।
….. তুই কোনে রিনা? কমিন দিয়ে আসপো? নুরুল হাতড়ে খোঁজে রিনাকে। তুই তো এহন ব্যাটা ছাওয়ালের মত, তোক লিয়ে সংসার করা যাবিনানে।
….. সরো! রিনা এক ঝটকায় সরে যায়।খুব বমি পাচ্ছে রিনার। নুরুলের স্পর্শে বমি পায়।
নুরুল ঘোঁৎঘোঁৎ করছে। জোর করে রিনার কাছে পৌঁছে গেছে নুরুল।
…. শালার মেয়েমানুষ! তোর তেজ কত? ঠাপাবোনে আইজ!
শরীরের আসলটুক কাইটে ফেললি পর মেয়েমানুষ কি আর মজা লাগে! শালার…..
*
সারারাত রিনার ঘুম হলো না। হাত পা জ্বালাপোড়া করছে। দরদর করে ঘামছে রিনা। অস্থির লাগছে।
সকালের আলো ফুটতেই কল পাড়ে ভীড় আর হৈচৈ শুরু হয়। সবাই কাজে যাবার আগে কল পাড়ে যায়। রিনা গামছাটা ঝুলিয়ে বরই গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
গোসলঘরে কতগুলো যে ফুটো! তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে টিবি গেইটের দিকে খুব জোরে হাঁটছে রিনা।
মাথাটা ঘুরছে। খুব শক্ত করে নিজেকে ঠিক রাখতে চায় রিনা।
*
হোটেলের বারান্দার একপাশে শুয়ে আছে রিনা। বুকের ভেতর হাতুড়ি চলছে মনে হয়। বুকের শব্দ কানে এসে লাগে।
কাল রাতে নুরুল তাকে ব্যাটাছেলে বললো! আসলেই তো মাসিক না হলে মেয়েমানুষ আর ব্যাটাছেলে তো একই!
বিয়ের পর মনে হয় একরাতও নুরুল তাকে ছাড়েনি!
আর এখন নুরুলের মন ভরে না।
কাঁদছে রিনা…. জরায়ু অপারেশন ভুলই হলো, না করলেই হতো!
নুরুল গ্যারেজের কাজ শুরু করার আগে এক কাপ চা খেয়ে সিগারেট ধরায়। এটা তার প্রতিদিনের অভ্যাস।
*
ডাক্তারের সামনে বসে আছে রিনা।
…. আফা আমি মেয়েমানুষ থাকপের চাই। ব্যাটাছেলে হবের চাইনে! স্বামী তালি পর আমাক থুয়ে নিকে করবিনি! দুই ছাওয়াল লিয়ে আমি কোনে যাবোনে! রিনা কাঁদছে।
…. ওষুধ দিলাম। রোজ রাতে খাবে সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করো না! ডাক্তার আপার কথায় রিনার আরো মন খারাপ হয়। গরীব মানুষ বছর জুড়ে ওষুধ কেনে কিভাবে?
*
শরীরটা ভাল নেই আজ কদিন। রিনা হোটেলের কাজটা ছেড়ে দিয়েছে।
বিছানায় শুয়ে থাকে সারাদিন। ছেলে দুইটার কথা খুব মনে পড়ে। কতদিন দেখে না ওদের। গতবার রোজার ঈদে বাড়ী গিয়েছিল। প্রায় বছর ঘুরে আসছে।আর কদিন পরই রোজা শুরু হবে।
বিয়ের পর খুব সুখের সংসার ছিলো। নুরুল ক্ষেতে কাজ করতো। হাটবারে হাট করে আনতো। রিনা সংসার করতো। শ্বশুর শ্বাশুড়ি ছিলো,ননদ,দেবর ছিলো। তারপর একে একে সবাই যে যার মত। ননদের বিয়ে,দেবরের বিয়ে হলো। শ্বশুর শ্বাশুড়ি মারা গেলো এক বছরের মধ্যে।
রিনা দুই ছেলের মা হয়ে গেছে ততদিনে।
*
বাহিরে কিসের হৈচৈ? অনেক মানুষের গলা শোনা যায়। অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ শুয়ে থেকে ধীরেধীরে ঘরের বাইরে আসে রিনা।
জটলাটা একটু দূরে। সখিনার ঘরের কাছে। সখিনার ঘরে অনেক মানুষ। একই দেশের মানুষ তারা। সখিনার বাড়ী রিনাদের বাড়ী থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে।
প্রথম যখন বস্তীতে আসে রিনা আর নুরুল, তখন সখিনা আর তার স্বামী অনেক উপকার করেছে। রিকশা চালাতো সখিনার স্বামী। হঠাৎ একদিন গাড়ীর চাপায় মারা যায়। সখিনার মেয়েটা চৌদ্দ বছর বয়স। বেশ ডাঙ্গর হয়ে গেছে। রিনাকে মেয়েটা খালা ডাকে। প্রায়ই আসে রিনার ঘরে। কখনো রিনার মাথায় তেল দিয়ে দেয় আর গল্প করে।
স্কুলে ভর্তি করেছিলো মেয়েটাকে কিন্তু মেয়েটাই পড়ালেখা করতে চায় না। কোরআন শরীফ শুরু করে শেষ করেনি।
*
সখিনার গলা শোনা যায়। রিনা ধীরেধীরে এগোয়।
মেয়েটার আজ বিয়ে! কই সখিনা তো কিছু বলেনি!
পোলাওয়ের গন্ধ আসছে। লাল শাড়ী পরে বিছানায় বসে আছে মেয়েটা। খুব সুন্দর দেখায়।
বাইরে বরপক্ষ আসার কথা শুনে সবাই হুলস্থুল করছে।
বর এসেছে! বর এসেছে!
রিনা বর দেখতে যায়।
হলুদ পাঞ্জাবি পরে রিকশা থেকে নামে নুরুল। রুমালটা মুখের ওপর…….
রিনাকে দেখে কথা বলে নুরুল…. সরেক, সইরে খাঁড়া শালার ব্যাটাছেলে!
তোক আসপের কইলো কিডা?
*
রিনা আবার বুকের সেই শব্দ শুনতে পায়। কে যেনো হাতুড়ি চালায় ক্রমাগত।
সখিনার ঘরে তখন অনেক আনন্দের নহর বয়ে যায়।
ছবি: গুগল