
ভদ্রলোককে দেখে মায়াই লাগলো। এক হাতে কফির মগ, আর অন্য হাতে বড়ো একটা টোস্ট বিস্কিট। মোবাইলটা কাঁধ দিয়ে কানে ঠেকিয়ে কথা বলছেন । স্যুট টাই পড়া, সদ্য শাওয়ার নেয়া ঝকঝকে মানুষটি গাড়ীর পেছনের সিটে বসেছেন। সকাল আটটা‘র জ্যামে অফিসগামী আমিও তার পাশের গাড়ীতে। পাশাপাশি জানালায় তাকে দেখে মনে হলো ব্যস্ত এই শহর ভদ্রলোককে ঠিক মতো প্রাতরাশ করার ফুরসতটাও দেয়নি। কর্মদিবসের ভোরসকালে এক মগ কফি আর একটি টোস্ট নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেছেন। সেখানেও মোবাইল ফোন বাগড়া দিচ্ছে। টোস্টটা কি তিনি আদৌ শেষ করতে পেরেছিলেন? কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো কি? সিগনাল ছেড়ে দেয়ায় উত্তরগুলো আর আমার জানা হয়নি। এ শহরের মানুষ আজ সকাল থেকেই এতোটা চক্করে থাকেন যে, প্রাতরাশ তাদের জন্যে বিলাসিতা বৈ কিছু নয়। অথচ, প্রাতরাশ একসময় রাজকীয় ব্যাপার ছিলো এ শহরে।
ভোরবেলায় অফিসের তাড়ায় যারা থাকতেন, তারাও পেটপুরে সকালের নাস্তাটা করতেন। যারা সূর্য ওঠার সময় হাটতে বেরুতেন তাদের অনেকেরই পছন্দ ছিলো মাঠা বা ঘোল। ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় প্রতি সকালে মাঠা নিয়ে বসতেন মাঠাওয়ালারা। কাঁচা মাখনের প্রলেপ দেয়া সেই মাঠা ছিলো বহু ঢাকাবাসীর খালিপেটে প্রথম পানীয়। খুব বেশীদিন আগের গল্প নয়। এই ঢাকার মানুষদের বেড টি খাওয়ার অভ্যেসটাও ছিলো। চলচিত্রে নয়, বাস্তবেই। সকালের নাস্তার আগে মাঠা বা চা যা-ই হোক না কেনো, জানান দিতো যে আরেকটি দিন শুরু হতে চলেছে এ শহরে।
কী থাকতো ঢাকাবাসীর প্রাতরাশে? পুরান ঢাকার কথা আগে বলি। ঢাকাইয়ারা গরম বাখরখানি আর মালাই চা দিয়ে শুরু করতেন প্রতিটা সকাল। পুরোনো শহরের প্রতিটা গলিতে খানদানি বাখরখানির দোকানগুলো জমজমাট হয়ে যেতো ফজরের নামাজের পর পরই। বিভিন্ন স্বাদের, নানা পদের সেই বাখরখানি। ঘিয়ে ভাজা, পনির দেয়া অথবা চিনির সিরার প্রলেপ দেয়া বাখরখানি আর মালাই চা। কিন্তু এগুলো মোটেই ব্রেকফাস্ট নয়। বরং সেটাকে স্টার্টার বলতে পারেন। মুল প্রাতরাশ তো আরো পরে। আর সেটার সরঞ্জাম চলতো সব বাড়ীর হেঁশেলে। হাতে বেলা রুটি আর সব্জি-ডিম কিন্তু খুব কম বাসাতেই জনপ্রিয় ছিলো। ঢাকাইয়াদের প্রিয় প্রাতরাশ পরোটা। সঙ্গে নেহারী, পায়া অথবা মুরগীর স্যুপ। মুরগীর স্যুপ বললে আবার আপনারা ভাবতে পারেন, চায়নীজ স্যুপ। আসলে তা মোটেই নয়। এই স্যুপ ভিন্ন। এটা অনেকটা মুরগীর কোরমার কাছাকাছি এক আইটেম। পুরোনো ঢাকাতেই এই রেসিপির উৎপত্তি। এখন অবশ্য এই আইটেম ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকার সর্বত্র। পরোটার সঙ্গে আরো একটা মজার জনপ্রিয় আইটেম ছিলো- লটপটি। ডাল আর মুরগীর গিলা কলিজা দিয়ে ঝাল করে বানানো এই মুখরোচক লটপটি পাওয়া যেতো প্রায় সব হোটেলেই। সকাল সকাল গরম খাসির তেহারী কাঁঠাল পাতা দিয়ে মুড়ে বিক্রি হতো বিভিন্ন গলির দোকানে। প্রাতরাশে পরোটার ব্যতিক্রম ছিলো এই তেহারী।
ব্রেকফাস্টে মিস্টান্নের কথা না বললেই নয়। খুবই জনপ্রিয় একটি মেনু ফেরি করে বিক্রি হতো একসময় এই শহরে। সাইকেল অথবা টানা ভ্যানে সুজি বা গাজরের শাহী হালুয়া গলিতে গলিতে দেখা যেতো খুব সকালে। সঙ্গে থাকতো খাস্তা পরোটা। খাস্তা পরোটা ছিলো যেমন নরম তেমনি সুস্বাদু। ঢাকাইয়াদের বাসায় বানানো প্রাতরাশের চাইতে এসব কেনা খাবারেই রুচী ছিলো বেশী। তবে ছুটির দিনে বাসায় বানানো খুদের ভাত অথবা ডালপুরি সদৃশ সেদ্ধ খ্যাতাপুরি দিয়ে প্রাতরাশও ছিলো বেশ জনপ্রিয়।
তখনকার ছোট্ট ঢাকা শহরের বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মধ্যে ইংলিশ ব্রেকফাস্টের চলও ছিলো চোখে পড়ার মতো। পাড়ার মুদি দোকান থেকেও কেনা যেতো বিভিন্ন বেকারীর পাউরুটি। সঙ্গে জ্যাম, জেলি আর মিল্ক ভিটার তৈরি মাখন। ডিম পোচ বা হাফ বয়েল ঘরেই বানিয়ে ইংরেজ প্রাতরাশ সেরে কর্মক্ষেত্রে বেরিয়ে যেতেন শহরবাসীরা। মৌসুমি ফলটাও নাস্তার টেবিল থেকে তুলে নিতে ভুলতেন না তারা। সকালে কাজে যাবার আগে বাসায় নয়, হোটেলে আয়েশ করে একসময় প্রাতরাশ সারতেন এ শহরের অনেক মানুষ। এখনো এই চল হয়তো আছে, তবে তা কমে গেছে নিশ্চিতভাবই। স্টার হোটেলে ছুটির দিন ছাড়া সকালের নাস্তার জন্যে আর ভীড় জমান না কর্মজীবীরা। সেখানে বরং ভীড় এখন ছাত্রছাত্রীদের। স্টার হোটেলের মতোই বেশ কিছু হোটেল এখনো ধরে রেখেছে তাদের প্রাতরাশের ঐতিহ্য। গত কয়েক দশক ধরে ইত্তেফাক মোড়ে দেশবন্ধুর পরোটা-সব্জি আজো একইরকম জনপ্রিয়। মহাখালী আর শান্তিনগরের জলখাবার, ঢাকা কলেজের উল্টোদিকে যাদব ঘোষ, নর্থ ব্রুক হল রোডের ক্যাফে কর্ণার, বনানীতে স্টার, ইংলিশ রোডের আল রাজ্জাক, বাংলাবাজারের চৌরঙ্গী হোটেল, ঠাটারি বাজারের গ্রীন সুইট, আর একদা মতিঝিলের ক্যাফে ঝিলসহ এরকম প্রাতরাশের জন্যে জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টগুলোর এখনো জনপ্রিয়তা থাকলেও আয়েশী প্রাতরাশ প্রেমিকরা সেখানে নিত্য যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছেন। মেগাসিটি ঢাকা শহরের স্বাস্থ্যের দিকে কেউ নজর না দিলেও, নগরবাসী কিন্তু নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি বড়োই সচেতন । ডায়েট করছেন যে যার মতো। কেউ কার্ব ছাড়ছেন, কেউবা সুগার। পরিমিত খাবার খাওয়ার ট্রেন্ডে আরো একধাপ এগিয়ে প্রাতরাশ আজ প্রায় শুন্যে নামিয়ে আনছেন এই শহরেরে মানুষ। ব্রেকফাস্ট স্কিপ করে ব্রাঞ্চ করাটা এখন এক নতুন ফ্যাশন। তারকা হোটেলগুলোও তাই ব্রাঞ্চের অফার ছাড়ছে নিয়মিত। সুপারশপে ঢুকলেই আজ চোখে পরে বিদেশি প্যাকে কর্নফ্লেক্স, মুজলি, ওটসের মতো প্রাতরাশ সিরিয়াল।
লো ফ্যাট মিল্ক, ড্রাই ফ্রুট বা ব্রাউন ব্রেড দিয়ে শরীরটাকে ঝরঝরে রাখার চেস্টা। ‘প্রাতরাশ নাকি করতে হয় রাজার মতো’- এই ধারনাকে অনেকটাই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন এ শহরের বহু মানুষ। রাজার প্রাতরাশ মেনু কর্নফ্লেক্সই হোক বা নেহারী-তেহারী, কোনোকিছুই তেমন টানছে না রাজধানীবাসীকে। বদলে যাওয়া ব্যস্ত ঢাকার প্রতিটা সকাল কর্মজীবীদের কাছে আজ শুরু হয় নতুন নতুন বিভীষিকা দিয়ে, যেখানে প্রাতরাশ বোধকরি শুধুই সময়ের অপচয় মাত্র। এ শহর আমার অচেনা লাগে এখন ॥
ছবিঃ গুগল