
সাগর চৌধুরী লেখক, সাংবাদিক
বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।
আঠারো.
কলকাতার বাইরের কোন জায়গা থেকে বাংলাদেশ বা বিলেত থেকেও যেসব বন্ধুবান্ধব মাঝেমধ্যে আমাদের অতিথি হন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেককেই আমরা অন্তত একবার কলেজ স্ট্রীটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কেবল বইপাড়ায় ঘোরাঘুরি করার জন্য নয়, বইপত্রে সকলেই তো সমান আগ্রহী হন না, আমাদের উদ্দেশ্য থাকে কলেজ স্ট্রীটের আরো দু-একটা আকর্ষণের সঙ্গেও তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। এদের মধ্যে একটা তো কফী হাউজ বটেই, অন্যটাও কম আকর্ষণীয় নয় গোলদিঘি বা বিদ্যাসাগর সরোবরের পাশের রাস্তায় একটা শরবতের দোকান, নাম ‘প্যারামাউন্ট’। আমরা নিজেরাও কলেজ স্ট্রীটে গেলেই এই দোকানে একবার যাবোই যাবো। কফী হাউজের মতো প্যারামাউন্ট-ও এই এলাকার একটা অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় আড্ডার জায়গা, এবং গরমে ঘোরাঘুরিতে শুকিয়ে আসা গলা ভেজানোর নিছক ঠেক ছাড়াও আরো কিছু।
শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে উপনীত এই শরবতের দোকান প্রথম খুলেছিল ১৯১৮ সালে ১-এ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট এই ঠিকানায়, তখন অবশ্য এটার নাম ছিল ‘প্যারাডাইজ’। এই তারিখ থেকে ধরা হলে শতবর্ষ অতিক্রান্ত ইতিমধ্যেই। তারপর ১৯৩৬ সালে দোকানের ঠিকানা পালটে হয় ১/১/১-ডি বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, নতুন নাম হয় ‘প্যারামাউন্ট’। একাদিক্রমে এত বছর ধরে একই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, এবং একই ঠিকানায়, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা শহরে খুব বেশী নয়। যে বাড়িতে এই দোকান তাকে, এবং তার সঙ্গে দোকানকেও, কলকাতা পুরসভা ‘হেরিটেজ বিল্ডিং/এস্টাব্লিশমেন্ট’ বা অবশ্য সংরক্ষণযোগ্য ঐতিহ্যশালী ভবন তথা প্রতিষ্ঠানের তকমা দিয়েছে।
প্যারামাউন্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা নীহাররঞ্জন মজুমদার ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। স্বাভাবিকভাবেই, স্বাধীনতা-পূর্ব দিনগুলিতে এই দোকান হয়ে উঠেছিল বিপ্লবী বা স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের জমায়েত হওয়ার ও আত্মগোপন করার অন্যতম জায়গা। সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো নেতারাও অনেক সময় এখানে মিলিত হতেন তাঁদের কর্মকৌশল নির্ধারণের জন্য আলাপ-আলোচনা করার উদ্দেশ্যে। এখনও দোকানের প্রাচীন মার্বল্-টপ্ টেবিলগুলির পাশে পাতা বেঞ্চে বসে পেছনের উঠানে যাওয়ার দরজার গায়ে ঝোলানো কালচে সবুজ মলিন পর্দার দিকে তাকালে হঠাৎ করে যেন মনে হয় যে ওপাশে লোকচক্ষুর আড়ালে বিপ্লবীরা বোধহয় গোপন সলা-পরামর্শে নিযুক্ত। তবে কেবল সেকালের বিপ্লবীরা নন, অন্যান্য নানা ক্ষেত্রের বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিও প্যারামাউন্ট-এর শরবতের স্বাদ উপভোগ করার জন্য এখানে আসতেন, বা আজও আসেন, মাঝেমধ্যেই। দোকানের দেওয়ালে টাঙানো একটা বোর্ডে যে বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষকদের নামের তালিকা রয়েছে তাঁদের মধ্যে সুভাষ চন্দ্র বসু তো আছেনই, আরো আছেন কাজী নজরুল ইস্লাম, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, শচীনদেব বর্মণ, সত্যজিৎ রায়, বিকাশ রায়, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন প্রমুখ আরো অনেকে।
নীহাররঞ্জনের মজুমদারের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন প্রবাদপ্রতীম বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, যিনি ১৯০১ সালের ১২ই এপ্রিল তারিখে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতের প্রথম ওষুধ ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনকারী সংস্থা ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস্ অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস্’, যেটা সংক্ষেপে ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস্’ নামেই সুপরিচিত। কয়েক বছর আগে এই সংস্থাটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা অধিগৃহীত হয়েছে এবং এখনও নিজের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রেরই ফরম্যুলা অনুসারে নীহাররঞ্জন তৈরী করেছিলেন প্যারামাউন্ট-এর অতুলনীয় স্বাদের ‘ডাব শরবত’। ডাবের জল, বরফের কুচি, চিনির রস আর কচি ডাবের নরম শাঁস মিশিয়ে তৈরী করা এই শরবত সত্যিই এক অনবদ্য সৃষ্টি। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রই নাকি শরবতে ডাবের শাঁস যোগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে তরুণ ছাত্রদের গলা ভেজানোর সাথে সাথে তাদের পেটেও ‘সলিড’ কিছু পড়ে। প্যারামাউন্ট-এর অন্যান্য জনপ্রিয় শরবতের মধ্যে আছে কাঁচা আমের শরবত, ক্রীম ভ্যানিলা, কোকো মালাই, রোজ (গোলাপ) মালাই, স্ট্রবেরী মালাই, তেঁতুল, লিচু এবং আরো নানা উপাদানে তৈরী পানীয়, স্বাদে-গন্ধে যাদের কোনোটারই সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না বাজারের অন্য কোন শরবত।
প্যারামাউন্ট-এর বর্তমান স্বত্বাধিকারী হলেন নীহাররঞ্জনের দৌহিত্র পার্থপ্রতীম মজুমদার। দোকানের সাবেকি চেহারা ও চরিত্রকে যথাসম্ভব অক্ষুন্ন রেখেই তিনি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন, কারণ তার প্রাচীনত্ব বিজড়িত পরিবেশও খরিদ্দারদের কাছে একটা প্রধান আকর্ষণ। কয়েক বছর আগে একবার দোকানের দেওয়ালে গোটা দুই কাচের পাল্লা দেওয়া তাক বা ‘শোকেস’ বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, বহু বছর ধরে নানা সংবাদপত্রে ও সাময়িক পত্রিকায় প্যারামাউন্ট সম্পর্কে যেসব খবর বা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ে আসছে তাদের, সেই সাথে বিখ্যাত ব্যক্তিদের লেখা প্রশংসাপত্র, সাজিয়ে রাখা যাতে সবাই সেগুলি দেখতে পায় এবং তাদের সংরক্ষণও করা যায়। কিন্তু তাতে দোকানের পুরানো পৃষ্ঠপোষকরা ক্ষুব্ধ হয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ জানাতে থাকেন যে তেমনটা করা হলে প্যারামাউন্ট-এর আদি ও অকৃত্রিম চেহারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁদের জোরালো আপত্তির চাপে তাক বসানোর পরিকল্পনা শিকেয় ওঠার উপক্রম হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দোকান কয়েক দিন বন্ধ রেখে লুকিয়ে কাজটা শেষ করতে হয়। এর ফলে যারপরনাই অসন্তুষ্ট প্রবীণ পৃষ্ঠপোষকদের কেউ কেউ নাকি সেই থেকে আর দোকানে পদার্পণ করেননি। এই দু’টো শোকেস এবং বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষকদের নামের তালিকা ও শরবতের ‘মেন্যু’ লেখা বোর্ডগুলি ছাড়াও দোকানের দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে বড় বড় শিংওলা হরিনের বেশ কয়েকটা ‘স্টাফ’ করা মাথা। এগুলি নাকি এককালে শোভা পেতো কলকাতায় হায়দ্রাবাদের নিজামের একটা প্রাসাদে। বছর আশি আগে নীহাররঞ্জন এগুলি এক নীলাম থেকে কিনে এনে নিজের দোকানের দেওয়ালে টাঙিয়েছিলেন। বেশ একটা পুরানো ইতিহাসের আবহ তৈরী হয়েছে তার ফলে, যেটা প্যারামাউন্ট-এর চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে গেছে চমৎকার।
প্যারামাউন্ট-এ দৈনন্দিন কেনাবেচা শুরু হয় বেলা এগারোটা নাগাদ, চলে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত ন’টা পর্যন্ত, তখনও খরিদ্দারদের ভীড় থাকলে হয়তো আরো একটু বেশীক্ষণ। গোড়ার দিকে দোকান খোলা থাকতো কেবল গ্রীষ্মকালে, শীতকালে বন্ধ রাখা হতো। তবে যে কোন ঋতুতেই পিপাসার্তদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা সামাল দিতে আজকাল দোকান খোলা থাকে বছরের বারো মাসই। পৌষ-মাঘের শীতেও হিমশীতল শরবতে চুমুক দেওয়ায় আগ্রহী লোকের অভাব হয় না। অনেকের কাছেই প্যারামাউন্ট-এর পানীয় কেবলমাত্র ‘তৃষ্ণার শান্তি’ নয়, একটি প্রিয় অভ্যাসও বটে। আজকাল দোকান থেকে শরবত কিনে বাড়ি নিয়ে আসার ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। অবশ্য কোভিড ১৯-এর প্রকোপে বছর আড়াই যাবৎ এই দোকানটির পানীয় কেনাবেচায় ভাঁটার পর্ব চলছিলো, অন্যান্য সমস্ত ব্যবসার মতোই। আমাদেরও ওদিকে যাওয়া হয়ে ওঠেনি এর মধ্যে। তবে এখন বোধ হয় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে ধীরে ধীরে, গরম পড়ার সাথে সাথে শরবতপ্রেমীদের ভীড় বাড়তে শুরু করেছে দোকানে। আমরাও হয়তো অচিরেই এক সন্ধ্যায় হাজির হবো নতুন করে প্যারামাউন্ট-এর পানীয়ের স্বাদ নিতে। দেখা যাক কবে সেটা হয়ে ওঠে ।
ছবিঃ গুগল