

বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।
একুশ.
সত্তরের দশকের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে আমি কলকাতার একটি অধুনালুপ্ত ইংরেজি দৈনিকে চাকরি এবং তার পাশাপাশি একটি কলেজে পার্ট-টাইম শিক্ষকতা করছি। কাগজে যোগ দেওয়ার আগে আমি ঐ কলেজেই পুরো সময়ের শিক্ষক ছিলাম। থাকতাম শহরের উত্তরাঞ্চলের এক প্রাচীন এলাকায়। দ্বিতীয় পেশাটির সুবাদে স্বাভাবিকভাবেই সতেরো-আঠারো থেকে বাইশ-চব্বিশ বছর বয়সী বেশ কিছু তরুণ বা সদ্য যুবার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল, তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার বেশ হৃদ্যতাও ছিল। ঐ সময়টায়, সকলেই জানেন, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তথা সারা পশ্চিম বাংলায় নক্শাল আন্দোলন তুঙ্গে। দিকে দিকে তথাকথিত ‘শ্রেণীশত্রু খতম’ অভিযান চলছে, ডাকঘরের পিয়ন থেকে শুরু করে তেলকলের মালিক বা অন্যান্য ব্যবসায়ী, ছোটবড় পুলিশ কর্মচারী, এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষক প্রায় কেউই খতম তালিকার বাইরে নন। উত্তর কলকাতারই এক পাড়ায় আমার একজন পুরনো বন্ধুর বাড়িতে আমি মাঝেমধ্যে যাতায়াত করতাম, সারা দিনের কাজের শেষে সন্ধ্যার পর। বন্ধু অবশ্য তখন বিদেশে, বাড়ির বাসিন্দা তার মা-বাবা, স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়া ছোট বোন আর জেঠামশাই। মধ্যবয়স্ক অকৃতদার এই জেঠামশাই ছিলেন লালবাজারে পুলিশের সদর দফ্তরে বড় মাপের অফিসার। তাঁকে সব সময়েই খুব সাবধানে থাকতে হতো, অফিসে যাওয়া-আসা করতেন পুলিশের গাড়িতে দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে, বাড়ির আশেপাশেও সম্ভবত সাদা পোষাকের পুলিশের নজরদারি থাকতো। কাজ থেকে বাড়ি ফিরতে প্রায় রোজই বেশ রাত হয়ে যেতো তাঁর। একদিন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমি ঐ বাড়িতে যাচ্ছি। আধো-অন্ধকার গলি দিয়ে কয়েক পা এগিয়েছি, হঠাৎ রাস্তার ধার থেকে দু’জন ছেলে আমার পাশে এগিয়ে এলো। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন একটু চেনা-চেনা লাগলো, আমার ছাত্র হবে কি? একজন আমার দিকে চেয়ে হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করলো, ‘কাকলিদের বাড়িতে যাচ্ছেন, স্যার?’ যাক, ‘স্যার’ বলছে যখন তখন আমার ছাত্রই হবে। আমিও ঈষৎ হেসেই জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ, এই একটু ।’ সামনের দিকে পা বাড়াতেই ছেলেটি আমার কানের কাছে মুখ এনে চাপা অথচ স্পষ্ট গলায় বললো, ‘কাকলির জেঠামশাই টার্গেট্। আজ রাতেই।’ আমি চমকে তার দিকে মুখ ফেরাতেই সে ও তার সঙ্গী নিমেষের মধ্যে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কী অবস্থা তখন আমার! কী করবো এবার? আর না এগিয়ে ফিরে যাওয়াই বোধহয় আমার জন্য নিরাপদ, কিন্তু এমন কথা শোনার পর সেটা করা কী আর সম্ভব? কপালে যা আছে তাই হবে ভেবে দ্রুত পা চালিয়ে কাকলিদের বাড়ির দরজায় পৌঁছে কড়া নাড়লাম। দরজা খুললেন মাসীমাই, আমাকে দেখে বললেন, ‘এসো, অনেক দিন পর এলে।’
আমি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, ‘হ্যাঁ, ঠিক সময় হয়নি। বাড়িতে আর কেউ নেই, মাসীমা?’
মাসীমা বললেন, ‘কাকলি তো গেছে কোচিং ক্লাসে, এসে যাবে একটু পরেই। ওর বাবা এই মাত্র গেলেন বাজারে, সকালে যেতে পারেননি। বসো তুমি। রাতে খেয়ে যেও?’
আমি বললাম, ‘আজ থাক মাসীমা, একটা কাজ আছে।’ তারপর একটু ইতস্তত করে আবার বললাম, ‘মাসীমা, একটা কথা বলছিলাম ।’
আমার মুখের দিকে চেয়ে মাসীমার বোধ হয় একটু খটকা লাগলো। সামান্য উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে বলো তো ?
রাস্তায় ছেলেটির বলা শব্দগুলোই বললাম মাসীমাকে। শোনামাত্রই তাঁর মুখ তো ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি প্রায় ছুটেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার পরেই পাশের ঘর থেকে টেলিফোনে ডায়াল করার শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম তিনি খবরটা কাউকে জানাচ্ছেন, নিশ্চয়ই লালবাজারে জেঠামশাইকেই।
মিনিট পাঁচ-সাত বাদে মাসীমা এঘরে ফিরে এসে আমার সামনের সোফায় ধপ্ করে বসে পড়ে বললেন, ‘ওঁকে জানিয়ে দিলাম। কী যে উপকার করলে তুমি!’
‘আমি নই মাসীমা, উপকার করেছে ঐ দুটি ছেলে,’ আমি বললাম , ‘কিন্তু কেন করলো সেটাই বুঝতে পারছি না।’
কথা না বলে মাথা নিচু করে বসে রইলেন মাসীমা। কয়েক মিনিট পর আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আজ আমি বরং যাই। আপনারা সাবধানে থাকবেন, আর কাকলিকে এসব কথা বলার দরকার নেই।’
মাসীমাও উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, চলেই যাও। তুমিও সাবধান থেকো। কী যে দিনকাল পড়লো!’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি খুব তাড়াতাড়ি গলিটা পার হয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়লাম। পর দিন সকালে মাসীমাকে টেলিফোন করে জানলাম জেঠামশাই আগের রাতে আর বাড়ি ফেরেননি, দুপুরের দিকে ফিরে ওঁদের জানাবেন নিজের নিরাপত্তার জন্য কী ব্যবস্থা করেছেন। দু-দিন পর মাসীমাই টেলিফোনে আমাকে জানালেন যে জেঠামশাই লালবাজারের অফিসারদের জন্য সংরক্ষিত আবাসনে চলে গেছেন। কিন্তু ঐ ছেলে দুজন কারা ছিল, আর কেনই বা তারা আমাকে দিয়ে জোঠামশাই এর জন্য সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিল তা কখনো জানতে পারিনি।
আরেকটি ঘটনা মাস দেড়েক পরের। ঐ সন্ধ্যাতেও আমি কাকলিদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর সাড়ে-আটটা নাগাদ বেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে এগোচ্ছি, একটা জায়গায় দেখি জনাচারেক ছেলে দাঁড়িয়ে, প্রায় পথ জুড়ে। তখন, সত্যি কথা বলতে কি, ঐ বয়সের কয়েকজন ছেলেকে হঠাৎ এক সঙ্গে দেখলে কেমন যেন নার্ভাস্ লাগতো, আর এই ছেলেদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন কিছুর অপেক্ষা করছে। নিজের অজান্তেই আমি বোধহয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, একটি ছেলে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় যাচ্ছেন? বাস ধরতে?’
আমি কোনমতে মাথা নেড়ে শুকনো গলায় বললাম, ‘হ্যাঁ ভাই ।’
আরেকটি ছেলে সরু চোখে যেন আমাকে জরিপ করে বললো, ‘কোন্ দিকে যাবেন?’
আমি একটা হাত দিয়ে ডান দিক দেখিয়ে বললাম, ‘ঐ দিকে ।’
ছেলেটি কিছুটা ধমকের সুরে বললো, ‘তা দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন? তাড়াতাড়ি চলে যান। আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
তার কথায় আমি এতটাই অবাক হয়ে গেলাম যে প্রশ্নটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘কীসের দেরী ভাই?’
সে অধৈর্যভাবে বললো, ‘এক্ষুনি অ্যাক্শন শুরু হবে যে! যান, চলে যান ।’
আমি আর দ্বিরুক্তি না করে প্রায় ছুটেই রাস্তা পেরিয়ে ওধারে চলে গেলাম। বাস স্টপ্ হাত তিনেক দূরেই। তখন একটা দোতলা বাস, সম্ভবত ৩৩ নম্বর, ঐ রাস্তা ধরে শ্যামবাজার-বেলগাছিয়া ছুঁয়ে পাইকপাড়া পর্যন্ত যেতো। ঐ বাসটাই ধরতে হবে আমাকে, কতক্ষণে যে আসবে! আরে, ঐ তো এসে গেছে, মনে হচ্ছে ৩৩ নম্বরই। বাসের গতি মন্থর হয়ে আসতেই আমি দরজার হাতলটা ধরার জন্য তৈরী হয়ে দাঁড়ালাম। ঠিক তখনই দেখলাম রাস্তার ওধারে গলিটার বাতিগুলো সব হঠাৎ এক সঙ্গে দপ্ করে নিভে গেল। বাসের পাদানিতে পা রাখতে রাখতে শুনতে পেলাম গলির ভেতরে পেটো ফাটার দুম্-দুম্ আওয়াজ। অ্যাক্শন সত্যিই শুরু হয়ে গেছে।