চব্বিশ.
একজন নিয়মিত কর্মী হিসাবে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস্-এর সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আমার চুক্তিভিত্তিক কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার মুখে কর্তৃপক্ষের তরফে একবার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিলো যে আমার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে। কিন্তু ততদিনে আমি পূর্ব লন্ডনের একটি স্থানীয় সরকারের ‘কাউন্সিল’ বা পৌর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বেশ মনের মতো একটা চাকরির প্রস্তাব পেয়ে গিয়েছি। ঐ কাউন্সিল তার এলাকায় বসবাসকারী লোকজনকে যেসব পরিষেবা প্রদান করে থাকে তাদের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কাউন্সিলের জনসংযোগ বিভাগ এক গুচ্ছ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলো। এজন্য একটা নতুন দফ্তর খোলা হয়েছিলো যার কাজ হলো স্থানীয় এলাকার মানুষজনের নানা ধরনের চাহিদার জরিপ করে তার ফলাফলের ভিত্তিতে বেশ কিছু তথ্যপুস্তিকা, প্রচারপত্র ইত্যাদি রচনা করে সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে সরবরাহ করা। এই নতুন দফ্তরে যে পদটির জন্য আমার কাছে কাউন্সিলের প্রস্তাব এসেছিলো তার নাম হলো ‘এথনিক কমিউনিটিজ্ ল্যাঙ্গুয়েজ কো-অর্ডিনেটার’, অর্থাৎ ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য জাতিগত সম্প্রদায় বা গোষ্ঠির ভাষাগুলির মধ্যে সমন্বয়বিধানকারীর ভূমিকা পালন করা। অন্যতম দায়িত্ব ছিলো সরকারী পরিষেবাসংক্রান্ত তথ্যাবলী বিভিন্ন ভাষায়, যেমন বাংলা, হিন্দী, গুজরাতি, পঞ্জাবি, এমনকী সোমালী ও চীনাও, অনুবাদের ব্যবস্থা করা। সেই সময়ে সরকারী নীতি ছিলো যে কোন পৌর কর্তৃপক্ষের এলাকায় যদি একটি বিশেষ জাতিগত সম্প্রদায় বা গোষ্ঠিভুক্ত কমপক্ষে পাঁচটি পরিবারের বাস থাকে, তাহলে সরকারী তথ্য ঐ গোষ্ঠির কথ্য ভাষায় অনুবাদ করিয়ে রাখতে হবে যাতে তারা কেউ চাইলেই ঐসব তথ্যসম্বলিত প্রচারপত্র বা পুস্তিকা তাদের সরবরাহ করা যায়। কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা বলার পর আমার কাছে কাজটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হলো, সেই সাথে এই ধারণাও হলো যে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বগুলি আমি ভালোভাবেই সামলাতে পারবো। তাছাড়া এই চাকরির আরেকটা লাভজনক বৈশিষ্ট্য হলো যে এটা স্থায়ী, সরকারী চাকরি, অবসরগ্রহণের বয়স হওয়ার পর থেকে আজীবন সুনিশ্চিত পেনসন। বিবিসি’র অনুষ্ঠান প্রযোজক-উপস্থাপকের পদ, অন্ততঃ আমরা ঐ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার সময় পর্যন্ত, প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই অস্থায়ী মেয়াদের হতো এবং অবসরভাতা বলে কিছু ছিলো না।
আজকাল অবশ্য শুনতে পাই এই জাতীয় কিছু কিছু সুযোসুবিধা চালু হয়েছে, তবে কতটা কী, বিশদ জানি না। অন্য দিকে, বিলেতে সরকারী চাকরির আরেকটা বিরাট সুবিধা হলো, অবসরগ্রহণের পর যে অবসরভাতা প্রাপ্য হয় তা আজীবন তো বটেই, ‘পেএবল্ এনিহোয়্যার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, অর্থাৎ দুনিয়ার যে কোন দেশে বসেই এই পেনসন ভোগ করা যায়, প্রতি মাসের নির্দিষ্ট তারিখে স্থানীয় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রাপ্য টাকা ঢুকে যায়। অবসর নেওয়ার মুখে কেবল ‘পেনসন সার্ভিস্’কে জানিয়ে দিতে হয় কোথায় এবং কোন্ ব্যাংকে পেনসন জমা পড়া দরকার। আবার বিলেতের বাইরের কোন দেশের ব্যাংকের বদলে বিলেতেরই ব্যাংকে পেনসন জমা পড়ার ব্যবস্থা করেও রাখা যায় কারণ আজকাল ‘ইন্টারনেট্ ব্যাংকিং’এর সুবিধা থাকায় যে কোন ব্যাংকে থাকা টাকা ইচ্ছামতো ব্যবহার করায় কোনই অসুবিধা হয় না। আমরা তো বিলেতবাসের পাট শেষ করার পরেও সেখানকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চালু রেখেছি এবং এদেশের স্থানীয় ব্যাংকের মাধ্যমেই নিয়মিত আদানপ্রদান করে চলেছি, কোন অসুবিধা হচ্ছে না। বিলেতের সরকারী পেনসন পাওয়ার ব্যাপারে আরও একটা বড় সুবিধা আছে। শুনেছি এদেশে, অর্থাৎ ভারতে, সরকারী কর্মচারীদের অবসরগ্রহণের সময় হয়ে এলে, তাঁদের নিজেদেরই পেনসন পাওয়ার আবেদন জানাতে এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় নথিপত্র যথাস্থানে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। এটাই নিয়ম কিনা সেটা আমি ঠিক জানি না, তবে অ্যামেরিকাতেও পরিচিত লোকজনকে এমনটা করতে দেখেছি, মনে হয়েছে খুবই ঝামেলার কাজ। বিলেতে কিন্তু সম্ভাব্য পেনসন-প্রাপককে এসব কিছুই করতে হয় না। সেদেশে অবসরগ্রহণের পর প্রতিটি ব্যক্তি যাতে যথাসময়ে ও নির্ঝঞ্ঝাটে তার প্রাপ্য পেনসন হাতে পায় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করে থাকে সরকারী ‘পেনসন সার্ভিস্’ এবং সেজন্য যেসব নথিপত্র দরকার সেগুলি তারাই যোগাড় করে বা তৈরী করে নেয়। অবসরগ্রহণের তারিখের যথেষ্ট আগেই পেনসন সার্র্ভিস প্রাপককে লিখিতভাবে জানিয়ে দেয় কোন্ তারিখ থেকে তার পেনসন চালু হতে চলেছে এবং তার পরিমাণ কত হবে, সেই সাথে এটাও জানতে চাওয়া হয় কোন্ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ঐ পেনসন জমা পড়লে প্রাপকের সুবিধা হবে।
প্রসঙ্গত, বিলেতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী প্রত্যেক ব্যক্তি, সে কোন চাকরিবাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য বা যে কোন সূত্রে কিছু আয় করুক বা না-ই করুক, ষাট বছর বয়স হওয়ার পর থেকে, অর্থাৎ ‘সীনিয়ার সিটিজেন’ হিসাবে পরিগণিত হওয়ার পর থেকে, প্রতি মাসে একটা সরকারী ভাতা পেয়ে থাকে যাকে বলা হয় ‘স্টেট পেনসন’। এটার পরিমাণ প্রধানত নির্ভর করে ঐ ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে কত বছর ধরে ‘ন্যাশনাল ইনসিওর্যান্স’ বা জাতীয় বীমার প্রিমিয়াম দিয়ে এসেছে তার উপরে। আবার, এই ন্যাশনাল ইনসিওর্যান্স-এর কিস্তি নিয়মিত দিয়ে যাওয়ার বদলে বিলেতের প্রত্যেক বাসিন্দা ‘ন্যাশনাল হেলথ্ সার্ভিস্’ (এনএইচএস্) বা জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার মাধ্যমে সমস্ত সরকারী হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে যাবতীয় চিকিৎসালাভের সুযোগ পায়। যারা এই বীমার প্রিমিয়াম দিতে পারেনি তারাও কিন্তু এনএইচ্এস্-এর পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয় না। এই ধরনের সরকারী দাক্ষিণ্যলাভের সুযোগ আছে ব্রিটেনের বাইরে কানাডাতেও। এই প্রসঙ্গে ব্রিটেনে প্রাপ্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পরিষেবার কথা এখানে উল্লেখ করে রাখছি। এটাকে বলা হয় ‘উইন্টার ফ্যুয়েল পেমেন্ট’ এবং বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিরা সবাই প্রতি বছর ডিসেম্বার মাসের শেষ থেকে জানুয়ারী মাসের গোড়ার মধ্যে এই এককালীন ভাতা পেয়ে থাকে। এটার উদ্দেশ্য হলো শীতকালে ঘরবাড়ি গরম রাখার জন্য অতিরিক্ত জ্বালানির খরচের খাতে কিছুটা আর্থিক সহায়তা দেওয়া। অ্যামেরিকায় তো চিকিৎসা দূরের কথা, প্রায় কোন পরিষেবাই বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। স্টেট পেনসন ছাড়া ব্রিটেনের অধিবাসীরা তাদের সরকারী চাকরির সুবাদে যে পেনসন পেয়ে থাকে তাকে বলা হয় ‘অক্যুপেশনাল পেনসন’। বলা বাহুল্য, যারা সরকারী চাকরি করেনি তারা এই পেনসন পায় না। বিলেতবাসের সময় আমরা কয়েক বছর সরকারী চাকরি করেছি বলে ‘স্টেট’ এবং ‘অক্যুপেশনাল’ দুই ধরনের পেনসনই পেয়ে থাকি এবং পেয়ে যাবো আজীবন। দ্বিতীয় পেনসনটি পাওয়ার ব্যাপারেও আমাদের নিজেরা কিছুই করতে হয়নি, সরকারের যে দফ্তরের কর্মী ছিলাম আমরা, তারা এবং পেনসন সার্ভিস্ মিলেই যা করবার করেছে।
অতএব বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করে আমি স্থির করলাম, বিবিসি’র সঙ্গে চুক্তির নবীকরণ না করে স্থানীয় সরকারের চাকরির প্রস্তাবে সম্মত হওয়াই আমার পক্ষে সমীচীন হবে। কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও দিলাম যে আমি বিদায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। বিবিসি’র সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিন্তু তখনই পুরোপুরি ছিন্ন হলো না। তার পিছনেও কারণ ‘ইংলিশ বাই রেডিও’। আমার আসন্ন প্রস্থানের কথা জেনে ‘বিবিসি ইংলিশ’ মুখ্যত প্রযোজক স্যু ককীল (যাঁর উল্লেখ আগেও করেছি) এবং ঐ বিভাগটির আরও দু-একজন কর্মকর্তা আমাকে বললেন যে তাঁদের ইচ্ছা বিবিসি’র নিয়মিত কাজ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পরেও আমি যেন ইংরেজি ভাষা শিক্ষার এই বেতারানুষ্ঠানটি বরাবরের মতোই বাংলা বিভাগের হয়ে উপস্থাপনা করে চলি। অবশ্য যদি নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর সময়াভাব বা অন্য কোন কারণে সেটা করা আমার পক্ষে সম্ভব না হয় তাহলে অন্য কথা। আমি নিজেও এই অনুষ্ঠানটি নিয়ে কাজ করা চালিয়ে যেতে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলাম। তাই তাঁদের প্রস্তাব নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করার পর আমি বললাম যে অনুষ্ঠান রেকর্ডিং-এর দিনক্ষণ আমার সময় ও সুবিধা অনুসারে রদবদল করে নিতে পারলে হয়তো সেটা সম্ভব হবে। দেখা গেলো, তাতে কোন সমস্যা হচ্ছে না, অতএব আমি রাজি হয়ে গেলাম। স্যু এবং অন্যরা বাংলা বিভাগের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন যে আপাতত ‘ইংলিশ বাই রেডিও’ অনুষ্ঠানটি বাংলা বিভাগের তরফে উপস্থাপনার ভার আমার হাতেই থাকবে।
কয়েক সপ্তাহ বাদে বিবিসি ছেড়ে স্থানীয় সরকারে যোগ দেওয়ার পর দেখা গেলো নতুন চাকরির সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে ‘ইংলিশ বাই রেডিও’র জন্য রেকর্ডিং করায় এবং সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে ও সময়ে অনুষ্ঠান পরিবেশন করার জন্য বুশ হাউজ-এ বিবিসি’র স্টুডিওতে উপস্থিত থাকায় আমার তেমন সমস্যা হচ্ছে না। অল্প দিনের মধ্যেই এই সময়সূচি আমার সড়োগড়ো হয়ে গেলো এবং সেই থেকে আর কোন অসুবিধা হয়নি। এর পর একাদিক্রমে চার বছরেরও বেশী ইংলিশ বাই রেডিও’র সম্প্রচার আমি চালিয়ে যেতে পেরেছি এবং সব মিলিয়ে আমিও খুসী ছিলাম, বিবিসি ইংলিশও সন্তুষ্ট ছিলো। কিন্তু তারপর স্থানীয় সরকারে আমার চাকরির কিছু চরিত্রগত পরিবর্তন হওয়ার এবং তার ফলে আমার নিজের দায়িত্ব বেশ খানিকটা বেড়ে যাওয়ার দরুণ বিবিসি’র অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার জন্য সময় বার করা আমার পক্ষে কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠতে লাগলো। অবশেষে নিতান্ত অপারগ হয়েই বিবিসি’র সঙ্গে আমার এত দিনের সম্পর্কে ইতি টানতে বাধ্য হলাম। নিজে কিঞ্চিৎ মনোকষ্টে ভুগেছিলাম অবশ্যই, বিবিসি ইংলিশও সামান্য নিরাশ হয়েছিলো, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া ব্যতিরেকে উপায়ান্তরও ছিলো না। পরে শুনেছি, ‘ইংলিশ বাই রেডিও’র অনুরাগী শ্রোতাদেরও কেউ কেউ নাকি আমার অনুপস্থিতিতে ক্ষুন্ন হয়েছিলেন।
ছবি: গুগল