
লেখক, সাংবাদিক
বিশিষ্ট সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একদা কর্মরত ছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগে। তারও আগে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা এবং বার্তা সংস্থায়। একদা নানান কাজের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ইংরেজি সাবটাইটেল রচনার কাজও করেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালকদের সিনেমায় তিনি ছিলেন সাবটাইটেল লেখক। এখন এক ধরণের অবসর জীবন যাপন করছেন। বসবাস করেন কলকাতা শহরে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ কিছুটা মেরুদূর হলেও কলম থেমে যায়নি। বই লিখছেন, অনুবাদ করছেন। সাগর চৌধুরী জীবনকে দেখেছেন নানান কৌণিকে আলো ফেলে। দীর্ঘদিন বিলেতে ছিলেন। ঘুরেওবেড়িয়েছেন নানান দেশে। জীবনও তাকে দেখেছে খুব কাছে থেকে। সেই জীবনপ্রবাহের গল্প শোনাতেই প্রাণের বাংলার জন্য কলম ধরলেন সাগর চৌধুরী। প্রাণের বাংলার পাতায় এখন থেকে জীবনের গল্প বলবেন তিনি।
আট.

আমার লন্ডনে পদার্পণের এবং বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের বাংলা বিভাগে প্রযোজক-উপস্থাপকের পদে যোগ দেওয়ার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার বিবরণ ইতোপূর্বে পেশ করেছি। তারই জের ধরে এবারে বিবিসিতে কাজ করার অভিজ্ঞতার উপরে কিঞ্চিৎ আলোকপাত। তবে সব কিছুর আগে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে একটি অকপট স্বীকারোক্তি বিবিসি’র কাছে আামার কৃতজ্ঞতার অবধি নেই। এটা অতিশয়োক্তি নয় মোটেই, তবে কী কারণে কৃতজ্ঞতা সেটা ক্রমশঃ প্রকাশ্য।
বাংলা বিভাগে হাজিরার প্রথম দিনটি আমার কেটেছিলো দিনের দু’টি প্রধান অনুষ্ঠান সম্প্রচারে সহকর্মীদের ভূমিকা ও কার্যকলাপ লক্ষ্য করে। অচিরেই এসব কাজ আমাকেও করতে হবে তো, তাই আগ্রহ নিয়েই সব কিছুর দিকে চোখ রেখেছিলাম। এর পরের চার-পাঁচ দিনেও আমাকে কোন অনুষ্ঠান সম্প্রচারে সরাসরি অংশ নিতে হলো না, তাই অন্যদের কাজকর্ম মন দিয়ে লক্ষ্য করে বোঝার চেষ্টা করলাম সময় হলে কী ধরনের কাজ কীভাবে আমাকে করতে হবে। সম্প্রচারে ব্যবহারের জন্য দু-একটা ছোটখাটো রেকর্ডিং অবশ্য আমাকে দিয়ে করানো হলো। সে সময়ে বুশ হাউজের পাঁচতলায় বাংলা, হিন্দী, উর্দু, নেপালী ও পশ্তু বিভাগের জন্য নিদিষ্ট ঘরগুলির এক পাশে গোটা তিনেক ছোট স্টুডিও ছিলো যেগুলির যন্ত্রপাতি নিজেরাই চালিয়ে প্রয়োজনমতো অনুষ্ঠানের অংশবিশেষ রেকর্ড করে নেওয়া যেতো, এডিটিং বা সম্পাদনাও করা যেতো। এগুলিকে বলা হতো ‘সেলফ্-অপারেটিং স্টুডিও’ বা সংক্ষেপে ‘সেলফ্-অপ্’। টেলিফোনে বহু দূরে অবস্থিত কোন ব্যক্তির সঙ্গে কথাবার্তা রেকর্ড করার ব্যবস্থাও ছিলো এগুলিতে। সব কিছুই রেকর্ড করা হতো টেপ-এ, ঐ টেপ-ই দরকারমতো এডিটিং মেশিনে কেটে ও জোড়া দিয়ে সম্প্রচারে বাজানোর উপযুক্ত করে নেওয়া হতো। আজকের ‘ডিজিট্যাল’ প্রযুক্তি তখনও চালু হয়নি।
কলকাতার আকাশবাণী ভবনে মাঝেমধ্যে দু-একটা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি, সেখানেও তখন বিভিন্ন বিষয় টেপ-এ রেকর্ড করেই ব্যবহার করা হতো। তবে আকাশবাণীর অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি ও পরিবেশন পদ্ধতির সঙ্গে, বিশেষ করে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে, বিবিসি’র অনুসৃত পদ্ধতির একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিলো। আকাশবাণীতে যেমন সংবাদের বিষয় নির্বাচন ও সংগ্রহ করতেন একজন, সংবাদভাষ্য লিখতেন আরেকজন এবং মাইক্রোফোনের সামনে বসে ঐ ভাষ্য পাঠ করতেন তৃতীয় এক ব্যক্তি। বিবিসিতে এই তিনটি কাজই করতে হতো একজনকেই, অর্থাৎ সেন্ট্রাল নিউজরূমের সরবরাহ করা ইংরেজী সংবাদ থেকে বেছে নেওয়ার পর তার বাংলা অনুবাদ ও মাইক্রোফোনের সামনে বসে পাঠ করার দায়িত্ব পালন করতেন একজনই। প্রয়োজনীয় কিছু ভাষ্য টেপ-এ রেকর্ড ও সম্পাদনার কাজ হয়তো অন্য কেউ করে দিতেন। সংবাদ ছাড়াও অন্যান্য প্রতিবেদন পরিবেশনের ক্ষেত্রেও মোটামুটি একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। প্রতিটা অনুষ্ঠান পরিবেশনের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন প্রযোজক/উপস্থাপক ছাড়াও আরো যে তিন থেকে চারজন, তাঁদেরও অনুবাদ ও পাঠ এই দুটো কাজই করতে হতো। বর্তমানে এই কাজগুলি কীভাবে করা হয়ে থাকে তা অবশ্য সঠিক জানিনা।

অচিরেই আমার সরাসরি সম্প্রচারে অংশ নেওয়ার পালা শুরু হলো। মাইক্রোফোনের সামনে বসে নিজের তর্জমা করা প্রতিবেদন পাঠ করায় আমি দু-এক দিনের মধ্যেই স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠলাম। আকাশবাণীর অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়তো আমার কাজে লেগেছিলো, তবে আমার সহকর্মীরা সকলেই যথেষ্ট আন্তরিকভাবে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি এবং তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া এসব কাজে সড়োগড়ো হয়ে ওঠা আমার পক্ষে সহজ হতো না নিশ্চয়ই। একটা কথা এখানে বলা দরকার মনে করছি, সেটা হলো এই যে আমাদের দৈনন্দিন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের প্রস্তুতি ও পরিবেশনের ক্ষেত্রে বিবিসি’র ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের তরফে কখনোই সরাসরি হস্তক্ষেপ করা হতো না। বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু নির্বাচনে আমাদের প্রায় সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিলো। কোন ভুল হলে তার সমালোচনা হতো অবশ্যই, তবে সেটা হতো গঠনমূলক সমালোচনা, তার বেশী কিছু নয়, তিরস্কার তো কখনোই নয়। সুতরাং আমাদের কাজের ব্যাপারে আমরা সকলেই মোটামুটি সন্তুষ্ট ছিলাম। সামগ্রিকভাবে বিবিসি-তে কাজের পরিবেশ ছিল চমৎকার, মাঝেমধ্যে একটা-দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া তেমন বিরোধ-বিতর্কের দৃষ্টান্ত দেখা যেতো না। বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সম্পর্কও ছিলো যথেষ্ট সৌহার্দপূর্ণ।
বছর দুয়েক পরে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো ‘ইংলিশ বাই রেডিও’ বা বেতার সম্প্রচারের মাধ্যমে ইংরেজী ভাষা শিক্ষার অনুষ্ঠানটি বাংলা বিভাগের হয়ে উপস্থাপনা করার। এটি ছিলো একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় অঞ্চলেরই শ্রোতাদের কাছে। এই অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করা আমি নিজেও খুবই উপভোগ করেছি। যেভাবে আমি অনুষ্ঠান পরিবেশন করতাম তা শ্রোতাদেরও নিশ্চয়ই পছন্দের ছিলো, কারণ তাদের কাছ থেকে নিয়মিতভাবে প্রশংসাসূচক চিঠি আসতো বিবিসি’র কাছে। একজন শ্রোতা যেমন লিখেছিলেন: ‘সাগর চৌধুরীর পরিবেশিত এই অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে মনে হয় তিনি বোধহয় আমাদের দেশ থেকে ‘ব্রেন ড্রেইন’ (brain drain)-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ইংরেজী শেখানোর জন্য এমন শিক্ষক যদি দেশে অধ্যাপনায় নিযুক্ত থাকতেন তাহলে কী ভালোই না হতো!’ এই ধরনের কয়েকটা চিঠি এখনও আমার কাছে রয়েছে।
এই অকিঞ্চিৎকর আত্মকথন শেষ করার আগে আসি বিবিসি’র কাছে আমার কৃতজ্ঞতার কারণ প্রসঙ্গে, যার উল্লেখ গোড়াতেই করেছিলাম। আমার বুশ হাউজে পদার্পণের প্রথম দিনেই বাংলা বিভাগের যাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিশেষ একজন যিনি আমার বিলেতবাসের সূচনা থেকে শুরু করে আজও পর্যন্ত আমার জীবনের একান্ত আপন ও সবচেয়ে মূল্যবান প্রাপ্তি। বিবিসি-তে যোগ দেওয়ার সুযোগ না পেলে আমার এই প্রাপ্তি কোন দিনই ঘটতো না, তাই এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতাবোধ অপরিসীম। (চলবে)
No Comment! Be the first one.