
গৌরী দেবীর সঙ্গে
তখন পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার একটি স্কুলে পড়ান বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।তাঁর বিয়ে ঠিক হয় বসিরহাটের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাথ্যায়ের কন্যা গৌরীর সঙ্গে। বিয়ের এক বছরের মাথায় বিভূতিভূষণের স্ত্রী‘র মৃত্যু হয়।গৌরী দেবীর হঠাৎ মৃত্যুতে শোক পেয়েছিলেন তিনি। তাই কিছুদিন প্রায় সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন করতে শুরু করেন। ওই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে এলোমেলো ঘুরে বেড়াতেও দেখা যেতো। এই ঘটনার প্রায় ২১ বছর পর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বিয়ে করেন। এবার স্ত্রী রমা দেবী।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কয়েক বছর পরে এসে ঘাটশিলায় একটি বাড়ি কেনেন। সেই বাড়িতেই জীবনের বাকি সময়টা কেটেছে তাঁর। নিজের অকালমৃতা প্রথম স্ত্রী গৌরীদেবীর নামে বিভূতিভূষণ বাড়িটির নাম রেখেছিলেন ‘গৌরীকুঞ্জ’। কিন্তু এই বাড়িটি কেনার পিছনে একটি গল্প আছে। বাড়িটি তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে, তা-ও বেশ কয়েক বছর আগে দেওয়া ধারের পরিশোধ হিসেবে।
বাড়িটি তৈরি করেছিলেন শিক্ষাবিদ শ্রী অশোক গুপ্ত। উচ্চশিক্ষিত অশোকবাবু সস্ত্রীক বিদেশে থাকতেন। অবসরের পর তাঁরা ঠিক করেন বিকলাঙ্গ ও অপরিণতবুদ্ধি শিশুদের শিক্ষার জন্য একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান চালু করবেন। আর এজন্য কোনো গ্রামের শান্তশিষ্ট জনবিরল পরিবেশ তাঁরা খুঁজছিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাদের পছন্দ হয়ে যায় ঘাটশিলার সুবর্ণরেখা নদীর অদূরে জায়গাটি।
বাড়ি তৈরি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ শুরু করেন সেই দম্পতি। সেই সময়েই অশোক দাশগুপ্তের সঙ্গে বিভূতিভূষণের পরিচয়। তাদের চমৎকার উদ্যোগের কথা শুনে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব ভালো লাগে। এ কাজে অশোকবাবুর অনেক টাকার প্রয়োজন এবং তা জোগাড় করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে শুনে তিনি পাঁচশো টাকা ধার দেন। পরবর্তীকালে নানা কারণে অশোকবাবুর উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখেনি। তিনি জড়িয়ে পড়েন প্রচুর ঋণের জালে। তার স্বাস্থ্যও ভেঙে যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় খবরটা জানতে পারলেও অশোক দাশগুপ্তের বেশি খোঁখবর নিতে যাননি। তাঁর মনে হয়েছিলো, এই অবস্থায় ভদ্রলোক মনে করতে পারেন বিভূতিভূষণ পাওনা টাকা ফেরত পাবার জন্যই তার খোঁজ নিচ্ছেন।
বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে অশোক গুপ্তের সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি দেখা। আর তখনই অশোক গুপ্ত বিভূতিভূষণকে তাঁর ঋণের পরিশোধ হিসেবে ঘাটশিলার বাড়িটি বিনা শর্তে লিখে দেবার কথা বলেন। ভদ্রলোকের প্রস্তাব শুনে অবাক হয়েছিলেন সেদিন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঁচশো টাকার পরিবর্তে একটা বাড়ি!? প্রথমে সেই প্রস্তাবে রাজি হননি বিভূতিভূষণ। কিন্তু অশোক গুপ্ত তাঁর কোন আপত্তিই শোনেননি। রেজিস্ট্রি করে বাড়িটি লিখে দিলেন বিভূতিভূষণের নামে। সেই বাড়িতে উঠে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির নাম রাখলেন ‘গৌরীকুঞ্জ’। সেই ‘গৌরী কুঞ্জ’ ছিলো বিভূতিভূষণের খুব প্রিয় একটি জায়গা। সময় পেলেই তিনি চলে যেতেন নদীর তীরে সেই বাড়িতে। ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৮ টা ১৫ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয় সেই বাড়িতেই।
প্রাণের বাংলা ডেস্ক
তথ্যসূত্রঃ মুকুল চক্রবর্তী/ ঘাটশিলায় বিভূতিভূষণ, কলকাতা রিডার্স
ছবিঃ গুগল