মুম্বাইয়ের প্রযোজক সোহনলাল সুচিত্রা সেনকে নিয়ে ছবি তৈরি করবেন। স্ক্রিপ্ট লেখার জন্য ডাক পড়লো তখন বয়সে তরুণ গুলজারের। গুলজার তখন পর্দায় সুচিত্রা সেনের অভিনয় দেখে মুগ্ধ। মহা উৎসাহে গুলজার চিত্রনাট্য লিখতে বসে গেলেন। খুব দ্রুত লেখার কাজ শেষ হয়ে গেলে প্রযোজক গুলজারকে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতার, বালিগঞ্জ প্লেসে সুচিত্রা সেনের বাড়িতে। এবার গুলজার স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাবেন মিসেস সেনকে। আর ঝামেলা বাঁধলো সেখানেই। সুচিত্রা সেনের মন মতো হয়নি লেখা।
তিনি নানান জায়গায় খুঁত ধরে স্ক্রিপ্ট পাল্টানোর জন্য উপদেশ দিতে শুরু করলেন। আর তখনই বেঁকে বসলেন গুলজার। তিনি গল্প পাল্টাতে রাজি নন। সেদিন গুলজারের সঙ্গে কিছুটা ঝগড়ার মতো ঘটনাও ঘটেছিলো বালিগঞ্জে সুচিত্রা সেনের বাড়িতে।
তারপর সময় গড়িয়েছে। প্রখ্যাত কবি, গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার গুলজারের লেখা কাহিনীতে অভিনয় করে ইতিহাস হয়ে আছেন সুচিত্রা সেন ভারতীয় চলচ্চিত্রে। ‘আঁধি’ ছবিতে তাঁর অনবদ্য অভিনয় আজও ভক্তদের মনের পর্দায় জীবন্ত হয়ে আছে।
গত ৬ মার্চ ছিলো সুচিত্রা সেনের জন্মদিন।অসাধারণ অভিনয়, গভীর আবেদন নিয়ে পর্দায় তাঁর উপস্থিতি বাংলা সিনেমার দর্শকদের আজও নিয়ে যায় স্মৃতির বারান্দায়।সেখানে ঘাড় ঘুরিয়ে আজও তাকিয়ে থাকেন সুচিত্রা সেন। উত্তমকুমারের সঙ্গে একটা মোটরবাইকে উঠে গান গেয়ে ওঠেন, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’। স্মৃতিমেদুর বাঙালির কাছে সুচিত্রা সেনের সেই পথ আজও শেষ হলো না। তিনি থাকলেন আমাদের ঘুম-তাড়ানিয়া হয়েই।
বেঁচে থাকলে সুচিত্রা সেনের বয়স হতো ৯১। এই অসাধারণ অভিনয়শিল্পীর জন্মদিনে প্রাণের বাংলার এবারের প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো, ‘মিসেস সেনের গল্প’।
সুচিত্রা সেনের বাড়িতে সেদিন গুলজার কী শুধু রাগ করে চিত্রনাট্যের খাতা গুটিয়ে উঠে চলে এসেছিলেন? না, তাঁর সঙ্গে বাদানুবাদও হয়েছিলো মিসেস সেনের। সুচিত্রা সেন যখন বেশ কয়েক জায়গায় স্ক্রিপ্টের সংশোধন চাইলেন, তরুণ গুলজার রেগে গিয়েছিলেন।রাগ লুকিয়ে না রেখে গুলজার সরাসরি বলেছিলেন,‘ অনেক ভাবনাচিন্তা করে স্ক্রিপ্টটা লিখেছি। আমি বদলাবো না। আর আমার মনে হয় না আপনি বিরাট একজন লেখক, যিনি কিছুক্ষণ একটা স্ক্রিপ্ট শুনেই বুঝে যাবেন, কোথায় কী বদল দরকার, কোন চরিত্রের ঠিক কী করা উচিত!’ সুচিত্রা সেন তরুণ চিত্রনাট্যকারের কথায় সেদিন এতটাই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন যে, কোনো কথা না বাড়িয়ে উঠে চলে গিয়েছিলেন। আর গুলজারও সেখান থেকে বের হয়ে এসে সোহনলালকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি লিখবেন না। গুলজার রাগ করে বলেছিলেন, ‘আপনারা মিসেস সেনকে দিয়েই স্ক্রিপ্টটা লেখান।’ গুলজারের কথায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন প্রযোজক সোহনলাল। কারণ তিনি সুচিত্রা সেনকে সাইনিং মানিও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
তারপর বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত হয়। এবার মুম্বাইয়ের আরেক প্রযোজক জে. ওমপ্রকাশ গুলজারকে ডাকেন একটা ছবি পরিচালনা করে দিতে। প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার শচীন ভৌমিকের একটি থ্রিলার গল্প অবলম্বনে তৈরি হবে সিনেমা। নায়িকার ভূমিকায় আবারও সেই সুচিত্রা সেন। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ছবি করার জন্য তখন খুবই আগ্রহী ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা সঞ্জীব কুমার। কিন্তু স্ক্রিপ্ট মিটিংয়ে বসার পর আবারও গল্প পাল্টে গেলো। গুলজারের বক্তব্য ছিলো, সুচিত্রা সেনকে নিয়ে ছবি তৈরি করতে থ্রিলারধর্মী গল্প বেছে নিতে হবে কেনো! মৌলিক কোনো গল্পের সন্ধান করা উচিত। সঞ্জব কুমার এবং স্বয়ং শচীন ভৌমিকও তখন তার কথায় সায় দেন। আর তখনই সূচনা হয় ‘আঁধি’ ছবির পরিকল্পনার। গুলজার গল্পটা লিখে উপস্থাপন করলে সবারই দারুণ পছন্দ হয়।
কিন্তু সেই স্ক্রিপ্টটা লিখতে আরও অনেকটা সময় পার হয়ে গেলো ক্যালেন্ডারে। গুলজার নিজেও অন্য কাজে জড়ালেন। কিন্তু তাঁর মাথার ভিতরে রয়ে গেলো আঁধি। কারণ ততদিনে গুলজার বিুঝে ফেলেছেন, মিসেস সেনের জন্য এমন একটা স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে যা দর্শক মনে রাখবেন বহুদিন। তাই মাদ্রাজে বসে গল্প লেখার কাজ বাদ দিয়ে গুলজার সোজা উড়ে গেলেন দিল্লীতে। একটা হোটেলের ঘরে নিজেকে বন্দী করে লিখতে বসলেন আঁধি ছবির গল্প।ওই হোটেলে বসেই চিত্রনাট্য লেখার কাজ শেষ করেছিলেন গুলজার। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অভিনয়ের জন্য তিনি নির্বাচন করেছিলেন সেই সঞ্জীব কুমারকে। সেই অভিনেতার সুচিত্রা সেন প্রেমের ঘোর তখনও কাটেনি। এক কথায় রাজি হয়েছিলেন সঞ্জীব। ওই ছবিতে তার নাম দিয়েছিলেন গুলজার জে.কে। এই জে.কে নামে একটি ছেলে হোটেলে তাঁর নানা ফরমাশ খাটতো। তার নামেটাই ছবিতে হলো সঞ্জীব কুমারের নাম।
হিট হয়েছিলো আঁধি ছবিটি। তৎকালীন ভারতের ইন্দিরা গান্ধী সরকার ১৯৭৫ সালে জরুরী আইনের বলে ছবিটি নিষিদ্ধ করেছিলো। কারণ ছবিতে সুচিত্রা সেন আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের কিছুটা গল্প মিলে গিয়েছিলো। মিসেস সেনের মেক-আপও ছিলো অনেকটা ইন্দিরা গান্ধীর মতোই। তবুও ‘আঁধি’ ছবির সাফল্য রোখা যায়নি। এই সিনেমাটি এখনও ভারতীয় ছায়াছবির ইতিহাসে অভিনয় এবং গানের জন্য অনন্য হয়ে আছে। এই ছবিতে গানে সুর করেছিলেন আরেক লিজেন্ড রাহুল দেব বর্মণ।
প্রাণের বাংলা ডেস্ক
তথ্যসূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা
ছবিঃ গুগল