
সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী
এক.
শব্দ নিয়ে কিছুটা কারবার করি কিন্তু শব্দ তাত্বিকের বেড়াজালে আবদ্ধ নই, অপভ্রংশও নই।আমি চট্টলের হুনি মাছ-শুটকি-লবনের ঘেরা, ডলু খালের বর্ষার প্রমত্ত স্রোত আর শীতের শীর্ণধারা আর বান্দরবান থেকে বয়ে আনা লালচে পাহাড়ী বালুকণার জুয়েলারি অলঙ্কার আভরণে সজ্জিতা চিকমিক তীরের এক চাটগাঁইয়া পিতার সন্তান, ফ্লোটিং, ভাসমান। রবীন্দ্রনাথ পথ ছাড়েন না। বোলপুরি মিহি বোলে ‘‘এই সরে দাঁড়াও’’ বললেও। “দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে… ঠাকুর, ক্ষম হে মম দীনতা…’’
দুই.
‘‘ঠাকুর তুমি কি কখনো সাতকাইন্না এসেছিলে তোমার জমিদারী দেখতে, আর লিখেছিলে
‘‘আমাদের ছোট নদী চলে এঁকে বেঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে?’’
মনে হয়না, কারণ সাতকানিয়া তো পানির দেশ, জলের নয়!! পুবে ,এই বাংলায় জল গলে পানি হয়, অদৃশ্য দেয়াল টপকে পশ্চিমে পানি জমে হয় জল। আবার আরো পশ্চিমে গেলে জল গলে যায়, আবার হয়ে যায় পানি।প্রকৃতির অপূর্ব খেলা।সুদূর পশ্চিমের ওরা “পান” করে আমরা এপার বাংলা-ওপার বাংলা ‘খাই’। “এপার বাংলা ওপার বাংলা, মইধ্যে বালুর চর তাহার মধ্যে বসত করে বালুর সওদাগর! বিন্নি ধানের শিউলি ফুলের খই-এ জলপানও হয় না! ছোটবেলার ছড়া, এখন এম্নেশিয়ার কারণে এলোমেলো। বয়সের ভাড়ে খোড়া রাসভের পৃষ্ঠে , মন্থর যাত্রা দীর্ঘ পথ পরিক্রমা, তবুও যাচ্ছি।
তাই মাঝে মাঝে প্রশ্ন শুধাই আমি আসলে কে? শিকড় কোথায়। খ্যাপা খুঁজে ফেরে শিকড়ের পরশ পাথর।নচিকেতা যদিও গেয়ে দিল হুট করে, সবই নাকি ঝুট পাথর! ইদানিং অনেক প্রশ্নের উত্তর নিরেট দেয়াল থেকে ক্যারামের গুটির মতো রিবাউন্ড হয়ে ফেরত আসে। দেখি!
তিন.
আরাকানীদের রক্ত, বার্মার হলুদ রক্ত, আরব জলদস্যুদের রক্ত , ফেনী নদীর ওপার থেকে পলিমাটি মাখা কৃষ্ণকায় কৃষক-লাঙ্গলের রক্ত সব কিছুর সমাহার , জটিল সরল অংকের সহজ সমাধান, আমি গর্বিত বাঙালি, আমার চেতনার আভিজাত্য, আমার অহংকার বাংলাদেশ । আমি নবাব বাদশাহ, জমিদার, বাবর, আলেকজাণ্ডার, চেঙ্গিস কিংবা শক-হূন- মোগল পাঠানের খায়েশী হেরেমের খাঞ্চার অপভ্রংশ নই ,গর্বও করিনা।আমি আভিজাত্যের দরদালানের ফাঁকফোকরের ফুরুৎ উড়ে যাওয়া চড়ুই পাখি নই, আমি মা মাটির তালগাছের বাবুই পাখি, নিজের ঘর নিজেই বানাই খড়কুটো দিয়ে।
পাঁচ.
হ্যাঁ, হতে পারি বাংলার মুসাফির, গাই “মুসাফির ,মোছরে আঁখিজল, ফিরে চল আপনারে নিয়া”। চলেছি , চলছি, চলবো তবে আপনারে নিয়া নয়, সবাইকে নিয়ে! পদ্মা, মেঘনা, যমুনা-ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলি, মাতামুহুরি মধুমতি কপোতাক্ষ, তিস্তার পলি বয়ে বঙ্গের উদাত্ত সাগরে, গাংচিল উর্মি মাথায়, শঙ্খের অনন্ত সঙ্গীতে। মেঘমুক্ত প্রভাতের রঙ , অবুঝ সবুজ শ্যাওলা , ফুটন্ত ভাতের মতো ভাট ফুল, শাপলার শুভ্রতা, পদ্ম কোরকে রক্ত চুম্বন আমার তুলিতে। সন্ধ্যার মেঘমালা আর আবীর আমার ওয়াইডস্ক্রিন ক্যানভাসে, কলমে ঝরনা, হোক না বল পেন, জীবনের ফল্গুধারা । কলকন্ঠ, কন্ঠস্বরে সোনার বাংলার জয় গান।
ছয়.
বিশ্বাস করুন, কবি আমার জন্যই লিখেছেন, তোমায় ভালোবাসি, যদিও মমত্বের জল জোড়াসাঁকো থেকে শিলাইদহের শুষ্ক দহে পানি হয়ে পান্তার সানকিতে পৌছে যায় না আজ! না পৌঁছুলে কি হবে, আমি তোমায় ভালোবাসি, সোনার বাংলা! দূর দিগন্ত রেখা থেকে কলসে পানি আনতে পান্তা ফুরালেও!!
দিবসের শেষ সূর্য্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল কে তুমি? মিলেছে উত্তর। আমি বাংগালী।
যাচ্ছি, যাবো, যেতে দাও, যেমন চলে গেল একটি বছর।
ডিসেম্বররে শেষ সূর্য ২০২০।
ছবি:আনসার উদ্দিন খান পাঠান