
তপতী বসু
(কলকাতা থেকে): পাঞ্জাবকে ভেঙে হরিয়ানা একটি আলাদা রাজ্য,তবে এই দুই এরই রাজধানী চন্ডীগড়৷দিল্লীর সীমান্তে হরিয়ানার এই বল্লভগড়৷ বেশ পুরাতন অঞ্চল৷রাস্তা আর আশেপাশের দালান থেকেই বোঝা যায়৷ এখানের গ্রামীণ চিকিৎসালয়ে আজ বারোদিনের অতিথি হয়ে যাযাবরের জীবন-যাপন । থাকতে হবে আরো দিন দশেক৷চারদিকে নিম,বট আর নানান বৃক্ষ ধীরস্থীর-বনবাসী মানুষের মতন ৷পুষ্প আর ফলহীন সেই সব সবুজপাতার উপরে রোদ বাতাসে খেলা করে৷ ছায়া থাকে নীচে,তাপ কমাতে অক্ষম ৷ কিছু মানুষ যেমন বাইরের আবরণ দিয়ে অন্তরের সব কষ্ট ঢেকে রাখে তেমনটা মনে হয়৷ আনন্দের সরল দিক হচ্ছে কখনও লুকিয়ে রাখার দরকার হয়না!
ছায়ায় বসে সাফাই কর্মীরা নিজেদের ভাষায় কথা বলে যায় একমনে ৷ কান পেতে থাকলেও তাদের আলাপ শোনা যায় কিন্তু বোঝার ভাষা জানা নেই৷একটু দূর-দালানের সামনের স্টিলের সারিবদ্ধ চেয়ার৷ দূর গাঁও থেকে সুস্থ হতে আসা রোগীর আত্মীয়রা সেখানে বসে থাকেন৷ প্রবল রোদের তাপে চারদিকটা ঝিমঝিম করে৷ বারান্দার পুরাতন জানালায় জঞ্জালের ওপর বসে থাকে পায়রা-একা৷কাছে গেলেও উড়ে যায়না কোনোদিন৷বিশ্বাস অথবা দীর্ঘদিনের অভ্যাস৷এখানে কেউ পায়রার মাংস খায়না,তাই হয়তো ভয় পেতে ভুলে গেছে ওরা!
এক পশলা বৃষ্টির পরে আজ একটু গরমের তাপ কম৷গাছের ডালে ডালে বসে আছে টিয়া—পাতার সঙ্গে মিশে থাকে৷দূর থেকে ভালো করে ঠাওর হয়না-তবু উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করি৷ঘরে এসে দেখি ফ্যানের ব্লেডে কেটে গেছে পায়রাটির ডানা৷রক্তের ছিটে সব জায়গায়৷একটুখানি হলুদ মাখিয়ে রেখে দেই বারান্দার কোণে,এখানে বিড়াল নেই৷ চাল-জল দিয়ে রাখি সামনে যদি খায়৷
একটা জিনিস খুব খেয়াল করেছি,এখানে ভাত ছড়িয়ে রাখলেও কাকের দেখা মেলেনি আজও৷এ’এমন জায়গা,যেখানে কাকের ডাক না শুনেই ভোর নেমে আসে৷
বাগেরহাট থেকে বল্লভগড়৷ হাজার মাইল পথের দূরত্ত্ব৷ গজ-মাইলের ফিতে দিয়ে মাপা যায় এই সীমানা৷ কাঁটা ছড়ানো পথটা গোলক ধাঁধার৷ হেঁটে আসার দুঃখ,বেদনা আঘাত বা কিছুটা লেগে থাকা অমর্যাদা তা মাপার তো কোনো মাধ্যম নেই৷ তবু নীরবতা আর সবুজের মধ্যে বসবাসে নিজেকে অনেক স্থির মনে হয়৷
একটু দূরেই আছে “রানিকা ছত্রী”৷
গত তিনদিন ছিল আকাশের মনভার আর কান্না,একটানা৷এখানের জমি নীচু,জল থমকে থাকে সামান্য ঝরা জলে৷এমন জমে যাওয়া জল দেখাতো আজকের নয়!মনে আছে আমাদের দালানবাড়ীর সামনের উঠোনে পুকুর থেকে উঠে আসা জলে থইথই করতো৷ টিনে ছাওয়া মস্ত আটচালার ঘরও ছিলো,তারই সিঁড়ি ঘেঁসে কাটানো নালা সে জল আঁটকে রাখতে পারতোনা৷ আমগাছের তলা ছাপিয়ে মন্দিরের বারান্দা ছূঁয়ে দিয়ে এগিয়ে ছড়িয়ে পড়তো সবখানে৷ ইট পাঁতানো থাকতো পরপর,শুধুই বর্ষার তিন মাস৷ আশ্বিনের সঙ্গে তা আবার গুছিয়ে রাখা থাকতো ৷
নালার মুখে বাঁশের খাঁচার বৈইছনে পেতে রাখতো মনিদা৷ প্রতি বছর নতুন বর্ষার ফোঁটা আকাশ থেকে ঝরলেই মা জোড়া নারকেল দিয়ে কিনতেন৷গ্রামের কোণে ঋষি পাড়া,সেখান থেকে কানাইএর মা,বকুলের দিদি..এমন বেশ কয়েকজন নিয়ে আসতেন বাঁশের খাড়ই- ডালা-কূলো-চাঙারি-খৈ চালার ছাঁকনি …৷দিব্বি বসে তাঁদের সঙ্গে গল্প জুড়তাম সেই যে আমার চিরস্পর্শে থাকা সোনা রঙের দিনগুলোতে৷
উঠানের সেই জলে কতবার ভিজিয়েছি পায়ের পাতা৷ দু’হাত মুঠো করে ধরে রাখা জল তুলে দিতাম মুখে৷ কখনও মেঘমালার ডাকে উঠে যেতাম বারান্দায়৷বৈইছনে ভরা সফেদ মৌরলা আর পুঁটি বারান্দার কোণে লাফাতো৷ছাই নিয়ে বটি পেতে কুটতে শুরু করতাম৷খাড়ই রেখে দিতাম উঠানে-বর্ষার জলেই ধুয়ে যেতো ৷
বল্লভগড়ের হাসপাতালে জমা জলে পা দিতে চায়না কেউই৷ উপর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি৷ গাছের নীচে কর্দমাক্ত জল মিশে আছে কত ময়লা৷উপরের পাতা আরো সবুজ ,তার সঙ্গে মিশে থাকে টিয়ার ঝাঁক৷ডাল বেয়ে নেমে আসে কাঠবেড়ালী আর তাদের ছানাপোনা৷সিঁড়ির একপাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে কুকুর৷পাশ দিয়ে হেঁটে যায় সিকিউরিটি গার্ড,সাফাই কর্মী৷যে যার মতন থাকে,মিলেমিশে৷
সেদিন সন্ধ্যায় সুমিত পায়রাটার ডানায় ওষুধ দিয়ে তোয়ালেতে মুড়ে রেখে দিয়েছিলো একটা কাগজের বাক্সে৷সকালে উড়তে না পারলেও পায়চারি করছিলো এখানে ওখানে৷কখন যে বিড়াল এসে ওকে ধরে নিয়ে গেলো…৷কিছুটা সময় কষ্ট লাগছিলো খুব৷কষ্টটা এমন একটা ব্যাপার,যতবারই আসুক-মনটা খারাপ হয়ই৷পাশে থাকেন একজন সার্জন৷তিনি সুমিতকে হিন্দিতে যা বললেন,তার বাংলা অর্থ ‘চিড়িয়ার ডানা আর বনের জন্তুর পা চলে গেলে সে নিজেকে বাঁচাতে পারে না।’
মানুষ আলাদা,এমনকি অর্ধেক জীবন নিয়েও সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করেও তাকে বাঁচতে হয়৷তাকে হারানো সহজ নয়৷
বাতাসে মাঝে মাঝে সরে যায় পাতার আড়াল৷ দেখা যায় ‘রাণীকা ছত্রীর’ চূড়া৷ ‘নাহার সিং’ নামে ছিলেন এক রাজা৷তাঁরই রাণীর মহল৷সামনে আছে চারদিকে ঘাট বাঁধানো ‘সুইমিং পুল’! একদিন সেই রাজার রাণী সেখানে শত সখী সনে স্নান করতেন৷
যাবার আগে পিছুটান রাখবোনা৷
সত্যিকার রাজ কাহিনী লিখে রাখবো৷
ছবি: লেখক