যায় দিন। কাজের ভিড়ে, ছোট ছোট অভিমানে, সংসারের হিসেব মেলানোর চেষ্টায়, ফোনে একই কথা অনেকবার বলে বলে যায় দিন।বর্ষাকালেপত্রিকা পড়ে, হেমন্তকালে ফেইসবুকে পুরনো বন্ধুকে খুঁজে পেয়ে, শীতে বাথরুমে গোসলের ফাঁকে হঠাৎ গুনগুনিয়ে ওঠা চেনা গানের সুরে আমাদের দিন যায়। পোস্ট অফিসের পাশে ভোরবেলা ঘুমিয়ে থাকা একলা কুকুরটারও দিন যায়। ভ্যানে চেপে কোতল হওয়ার জন্য এ পাড়ায় অনেক মুরগী এলে কুকুরটা স্বপ্ন দেখে আচমকা জেগে ওঠে। কুকুররা স্বপ্ন দেখে! দেখে হয়তো। প্রশ্নটা লিখতে লিখতে আচমকা মনে এলো।
সময়ের একটা ভালো গুণ হলো, সময় কেটে যায়। যদি না-কাটতো তাহলে সবকিছু স্তুপ হয়ে আটকে যেতো। মাথার উপরে ওই যে অবলম্বনহীন আকাশ, সেখানে মেঘের খেলায় দিন যায়, রাত্রি আসে। সবজিওয়ালা গলির মুখে হাই তোলে, তার গাড়িতে উজ্জ্বল পুঁইশাক শুয়ে থাকে তাদেরও দিন যায়।
এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো ‘যায় দিন’।
দিন যে কোনোভাবেই অতিক্রান্ত হতে পারে। সময় তো আর রাজউক ভবনের মাথায় ঘড়ির আটকে যাওয়া কাটা নয়; সে এগিয়েই চলে। রেজারের ব্লেডে ঝকঝক করে ওঠা ধারালো সূর্যের আলো, ব্যস্ত সকালে কফির মগ, একটা প্রায় পোড়া কাঠের মতো টোস্ট রুটির দৃশ্যের বিপ্রতীপে সামান্য সকাল ঘুমাতে আসে কখনও পরোটা-ভাজির দোকানের বেঞ্চিতে। রেডিও শুনতে ইচ্ছে করে কারও। স্থানীয় সংবাদে বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে, দূরে কোথাও বন্যার সংবাদ, ধান গাছে পোকার প্রকোপের কথা। বৃষ্টি আসবে? আসুক। তাতে কী এসে যায়? এই বর্ষায় বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় তার কোথাও যাবার তাড়া নেই আজ কাল অথবা পরশু। দিন এভাবেও যায়। ঘর ছাড়া মেঘের মতো ভেসে যাওয়া কোনো ভোরবেলা কেউ কেউ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অনেকটা পথ পার হয়ে যায় কোনো অচেনা পুকুরে ছিপ ফেলতে। যেখানে অপেক্ষার মতো জলে ভেসে আছে সাদা চাল আর মাছ। গোটা একটা সকাল পুকুর পাড়ে বসে মাছ ধরতে গিয়ে কে দেখেছে ব্যস্ত ফড়িংদের ওড়াউড়ি? বর্ষার ক্লান্ত দুপুরে আচমকা চারিদিক ছাই বর্ণ করে দিয়ে বৃষ্টি এলে কে খালুইতে কয়েকটা অসহায় ট্যাংড়া নিয়ে ফিরেছে বাড়ি?এমন করে আজও ফেরে কেউ?
দিন যায় আমাদের ফেইসবুকে পুরনো বন্ধু খুঁজে। কফির দোকানের নিরিবিলি ঠিকানা খোঁজে কেউ। অফিসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখা হয় না আকাশ। দিন যায় অফিসের নোটশিটে গেঁথে থাকা হাজার পিন খুলে। মাছ ধরার বিলাসী অবসরের সময় কোথায়?
‘আমার হিসাবনিকাশ টানাপোড়েন, আমার সারাদিন
‘অবসর নেই—তাই তোমাদের কাছে যেতে পারি না |’
শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন ‘অবসর নেই-তাই তোমাদের কাছে যেতে পারি না’ কবিতায়। এই টানাপোড়েন আর হিসাবনিকাশের সময় কাঁধে নিয়ে আমাদের দিন যায়।
বহুকাল আগে এই শহরে ঘোড়দৌড় দেখতে মানুষ ভিড় জমাতো রেসকোর্সে। সেই রেসকোর্স এখন নাম পাল্টে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেই রেসের মাঠে বাজি ধরা মানুষগুলোর কথা ভাবি মাঝে মাঝে। তাদের দিনও পার হতো অলস এক শহুরে বিকেলে ঘোড়ার উত্তেজনা ধার করে।তখন মানুষ সেলুনে বসে পত্রিকা পড়তো, ছুটির দিনে দাড়ি কামাতে যেতো। তখন সদ্য তৈরি করা পাউরুটির সুঘ্রাণে ভরে উঠতো কোনো গলি। ডাকপিওন আসতো চিঠি বিলি করতে। গলি, সুঘ্রাণ আর পিওনের দেয়া হলুদ খামের আনন্দে দিন যেতো মানুষের। এখন দিন যায় কার্ব মার্কেটের গলিতে ডলারের দাম যাঁচাই করতে করতে। এখন দিন যায় ব্যাংকের কাউন্টারে অচেনা ধান্দায়। আসলে দিন বদলে যায়। জীবন কেড়ে নেয় কত কিছু। আর সেই কতকিছুর ভিড়ে সময় কাটে রুদ্ধশ্বাস।
যায় দিন আমাদের। মাঝে মাঝে মনে হয় ট্রেনে চড়ে কোথাও যাই। অচেনা স্টেশনে নেমে ভাবি, কাঁচি দিয়ে ছাটা গাছেদের পাতার কথা। মন থেকে সাজিয়ে নিই স্টেশনে বইয়ের দোকান, ধোঁকা খাওয়া সাইকেল আর মলিন বেঞ্চি। দিন যেতে পারে বৃষ্টির দিনে স্টেশনের পাশে সিঙ্গাড়ার দোকানে বসে থেকে ঝাঁঝালো পেঁয়াজের ঘ্রাণ নিতে নিতে। দিন যেতে পারে কোনো নিবিড় রাস্তায় বাড়ির ঠিকানা খুঁজে নিতে। অফ্রিকার হাওয়া থেকে জাগুয়ারের মতো ভেসে আসা কোনো তাড়না নেই বর্ষাকালে মেঘের আঁচল টেনে ধরে, হেমন্তে উবু হয়ে বসে আর শীতে বেড়ার ওপর একমাত্র কম্বলখানি রোদে দিয়ে দিন গেলে হয়তো ভাই হতো। কিন্তু তাই কী ঘটে! দূরারোগ্য ব্যাধির মতো বেঁচে থাকা আর বেঁচে থাকা মানেই দিন পার করা। তখন এক একটা দিন যেন একটা জীবন। সময় বাজি ধরা রেসের ঘোড়া। ছুটছে আর ছুটছে।
বিভূতিভূষণ তাঁর ‘দিনের পরে দিন’ বইতে লিখেছেন, ‘‘আমি ছাড়া যেন আর দ্বিতীয় মানষে নেই, সমস্ত পথিবী আমার, গোটা তারাভৱা আকাশটা আমার। অলস স্বপনাতুর মনের অবকাশ-ভরা এক-একটি দিন, এক-একটি জ্যোৎস্নালোকিত সন্ধ্যা, যেন সহস্ৰ সহস্ৰ বৰ্ষজীবী কোনো দেবতার জীবনে একএকটি পল বিপল। অন্য সময়ে সেখানে কখনো যাইনি, যে সন্ধ্যাবেলা—যখন সে পথে লোক চলাফেরা করতো না, মানুষজনের কন্ঠস্বর কোনোদিকে শোনা যেতো না। একদিন সেখানে বসে আছি, এমন সময়ে পথের দিকে কাদের কথাবাত্তা শোনা গেলো। চেয়ে দেখি কয়েকজন লোক লন্ঠনজ্বেলে এইদিকেই আসছে। তাদের হাতে বড় বড় লাঠি। আমাকে দেখে বিস্ময়ের সরে বললে-এখানে কি করেন। বাব এত রাত্রে ? আমি বললাম—এই বসে আছি’’।
এই বসে আছি কথাটার মধ্যে অন্য এক জীবনের গল্প লুকিয়ে আছে। যায় দিন। স্বপ্ন হয়ে থাকে ছোট্ট কাঠের জাহাজ আর সমুদ্রে নুনের দাগ লাগা নাবিকের জীবন। অনেক জঙ্গলের পথ পার হয়ে মাছ শিকার করতে যাওয়া এক ফালি দুপুর এসে হাত ধরে। সকালবেলা ধারালো রেজার আর কফির ব্যস্ত পেয়ালাকে মিথ্যে করে দিয়ে বৃষ্টি নামে একদিন। আড়মোড়া ভাঙতেও চায় না সে সময়টা। যদি আঘাত লেগে ভেঙে পড়ে কল্পনার সামান্য স্বাদ।
ছবিঃ গুগল