
প্রভাতী দাস
আমার মায়ের একটি সম্বলপুরী শাড়ি ছিলো, উড়িষ্যা থেকে বাবার কিনে আনা। বাবা ‘৭৬-‘৭৭সালে(ঠিক মনে নেই) দিকে একটি অফিসিয়াল ট্যুরে ভারতে গিয়েছিলেন। সেটি-ই সরকারি চাকুরীতে বাবার প্রথম বিদেশ যাত্রা। বাবার কি আনন্দ ট্যুরের প্রায় তিরিশ জনের একজন হতে পেরে, আমাদেরও কতো জল্পনা-কল্পনা। তখন আমরা ময়মনসিংহের গৌরীপুরে থাকি। আমি সদ্যই স্কুল শুরু করেছি, স্মৃতি খুঁটিনাটি গুলো বেশ ঝাপসা হয়ে গেছে কবে কবে, কিন্তু অনেক কিছুই এখনও একদম স্পষ্ট। ট্যুর প্রোগ্রামটি ছিলো ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে ঘুরে ঘুরে কৃষির বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার দেখা এবং শেখা, বাবার সঙ্গে ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের আরও অনেকেই, বাবার খুব কাছের কয়েকজন বন্ধু । বাবা তার সেই ট্যুরে পশ্চিম বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, কর্ণাটক এইসব প্রদেশে ঘুরে বেড়ানোর মূল্যবান অভিজ্ঞতার গল্প উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাদের শুনিয়েছেন অনেক বছর।
বাবার গল্প থেকেই বিহারের জল স্বল্পতা এবং খরার কথা জেনেছিলাম। জেনেছিলাম রাজস্থানের ‘পিঙ্ক সিটি জয়পুর’, উড়িষ্যার পুরীর সমুদ্র, দিল্লীর আজমির শরীফে বিশাল পাত্রে রান্না…এই সমস্ত কিছু’র কথাও। সরকারি ট্যুরে গেলে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখানোটাও ট্যুরের অংশ হিসেবেই থাকে, সেই ঘুরে বেড়ানোর অংশে শপিংও থাকতো। বাবার মাছ-মাংস, কাঁচা বাজার বা খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত কোন কিছু ছাড়া অন্য সব কেনাকাটা/বাজার ভীষণ অপছন্দের ছিলো; শাড়ি, জামা-কাপড়ের কথা নাই বা বললাম। যদিও তখনকার সময়ে শপিং বা শাড়ি নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো বিলাসিতার সময় খুব কম মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণীদের ভাগ্যেই জুটতো, আমার মায়ের নিশ্চিত জুটতো না। তবুও বাবার কেনাকাটার বিমুখতা নিয়ে মায়ের চাপা একটা কষ্ট ছিলো বৈকি। আমাদের পরিবারের পুরুষদের কারোই মেয়েদের সাজপোশাক কেনাকাটা নিয়ে তেমন কিছু আগ্রহ না থাকায় সেটাই আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলাম। মজার ব্যাপার হলো, সেবার ভারত বাবার ভ্রমণ সঙ্গীদের মধ্যে কেনাকাটায় বেশ উৎসাহী, বিশেষ করে স্ত্রীদের জন্য শাড়ি-গয়না কিনতে উৎসাহী বেশ কয়েকজন ছিলেন। তাদের পাল্লায় পড়ে অথবা নিজ আগ্রহেই হয়তো বাবা সেবার মায়ের জন্য বেশ কয়েকটি শাড়ি কিনে এনেছিলেন।
বাবা ফিরে আসার পর তার ব্যাগের ভেতর থেকে যখন শাড়িগুলো বেড়িয়ে এলো, সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছিলেন বোধহয় আমার মা। সেবার আনা শাড়ির সংখ্যা বা নামগুলো সব আর মনে নেই, কিন্তু জয়পুর থেকে আনা বাঁধনি(চুন্দ্রি) এবং উড়িষ্যার থেকে কেনা সম্বলপুরীর কথা এখনো মনে আছে। চুন্দ্রি শাড়ির সংখ্যা কয়েকটি হলেও সম্বলপুরী একটি-ই ছিলো, কটন সম্বলপুরী; সেটি-ই মায়ের একমাত্র সম্বলপুরী। শাড়িটি মা ভীষণ ভালোবাসতেন। কত বছর ধরে যে পরেছেন, ধুয়ে-মাড় দিয়ে-ইস্ত্রি করে করে। প্রতিবার ধোবার পর বলতেন, ধুলে শাড়িটির রঙ আরও খোলে। আমি তখন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছি, শাড়ি সম্পর্কে একটু একটু উৎসাহ জাগছে। মায়ের শাড়ি ইস্ত্রি করতে গিয়ে এটা সেটা টুকটাক প্রশ্ন করতে শুরু করেছি। শাড়ির বহর, বাইন, রঙ এসমস্তের ভালো মন্দ একটু আধটু করে বুঝতে শুরু করেছি। মায়ের সম্বলপুরীটি সম্ভবত: কালো আর হালকা এবং গাঢ় বাদামী রঙে বোনা ছিলো(আমার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এসেছে)। শাড়িটির রং কখনও নষ্ট না হলেও অনেক বছর ধোয়া-মাড়-ইস্ত্রি করতে করতে সেটি ছিঁড়ে গিয়েছিলো একসময়। সেটি দিয়ে কাঁথা বানানো হয়েছিলো তখন, মা সেই কাঁথাটি ধরেও ধরেও সম্বলপুরী শাড়িটির প্রতি তার ভালোবাসার কথা বলতেন। মায়ের এতো ভালোবাসার কারণেই হয়তো, সম্বলপুরী শাড়ির যে চিত্রটি আমার মনে আঁকা হয়ে গিয়েছিলো সেটি বাদামী আর কালো সুতোয় বোনা। আস্তে আস্তে আমিও শাড়ি পরতে শুরু করলাম, সম্বলপুরীর কথা অবশ্য ভুলেই ছিলাম আরও অনেকগুলো বছর। অনেক বছর পর আমেরিকায় এসে ডেট্রয়েট-এ উড়িষ্যার একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়, রেসিডেন্সিতে আমার এক বছরের জুনিয়র। ওকে দেখেই ওড়িশি শাড়ি’র প্রতি আমার আকর্ষণ। ওর বোধহয় সব রঙের একটা করে বোমকাই ছিলো। বোমকাই যে ওড়িশি তখনি শিখলাম, কিন্তু সম্বলপুরী শাড়ি-ও ওড়িশি শাড়ির-ই প্রকারভেদ তখনো জানতাম না।। তখন সিল্ক ওড়িশি-ই চিনতাম শুধু। আস্তে আস্তে আমার শাড়ির জ্ঞান যখনও আরও বাড়লো, তখন জানতাম, ওড়িশি শাড়ির-ই আরেকটি বহুল ব্যবহৃত নাম, ইক্কত।
সুতি এবং সিল্ক; দুই সুতোতেই ইক্কত বানানো হয়, পাড়-আচল-জমিনের বুননে হাজারো ভিন্নতা থাকলেও ইক্কতের নকশায় একটা বিশেষ ধরণ আছে, চেনা কঠিন কিছু নয়। ইক্কত প্রেমী শাড়ি অনুরাগী’র সংখ্যা প্রচুর, তাদের দলে আমিও যোগ দিলাম। ইক্কতের শাড়ি কেনা শুরু হলো আমার; সিল্ক এবং সুতি দুই রকমেরই। ফেলোশিপ শেষ করে চাকুরীতে যোগ দেবার পর জানলাম, আমাদের প্র্যাকটিসের যিনি পাইওনিয়ার সেই ডাঃ মিশ্রও উড়িষ্যার। তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আরও জানলাম তিনি শুধু উড়িষ্যায় নন, তার বাড়ি সম্বলপু্র-এ। মায়ের সেই সম্বলপুরীর স্মৃতি ফিরে এলো মনে, আমি তাকে আমার মায়ের সেই সম্বলপুরী শাড়িটির গল্প শোনানোর লোভ সামলাতে পারিনি। তিনি আমার গল্প শুনে একগাল আনন্দের হাসি দিয়ে বললেন, সম্বলপুরী তাঁতিদের ঘর-বাড়ি তাদের গ্রামেই, সুতো কাটা, রঙ করা, তাঁতে বোনা; এই সমস্তই তার শৈশবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি আরও বললেন, পরের বার দেশে গেলে তিনি আমাকে একটি সম্বলপুরী শাড়ি অবশ্যই এনে দেবেন। ডাঃ মিশ্র তার কথা রেখেছিলেন, পরের বার তিনি এবং তার স্ত্রী দেশে গিয়ে আমার জন্য একটি সম্বলপুরী শাড়ি নিয়ে তবেই ফিরেছিলেন। সুন্দর একটা প্যাকেটে মুড়ে শাড়িটি তিনি আমার অফিস ডেস্কে রেখে দিয়েছিলেন একটি ছোট্ট নোট সহ। আমি অফিসে বসে কয়েকবার প্যাকেটটি খুলতে গিয়েও খুলিনি, খুব বিশেষ একটি শাড়ি দেখবো আশা করে বসে ছিলাম। বাড়ি এসে প্যাকেট খুলে শাড়িটি দেখে, অনেক খুশীর সঙ্গে মন খারাপ লাগাটিও অনুভব করলাম সমান তীব্রতায়। ডাঃ মিশ্রের আনা শাড়িটি সিল্ক সম্বলপুরী, যাকে বোমকাইও বলে, সবুজ জমিনে লালচে মেরুন টেম্পল পাড় আর ঘন কাজের আঁচল: এক নজরে ভালো লেগে যাবার মতোই একটি শাড়ি। তবুও আমার মন খারাপ! আমি যেন ভুলেই গিয়েছিলাম সম্বলপুরী সব শাড়ি-ই কালো আর হালকা এবং গাঢ় বাদামী সুতোয় বোনা হয়না…। আমার সম্বলপুরী কালেকশনে অনেক শাড়ি জমা হয়েছে, শুধু কালো আর বাদামী সুতায় বোনা একটিও নেই।