
সম্ভবত তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। মধ্য আশির ঘটনা। ক্লাসরুমের পড়া একটুও ভালো লাগতো না। ফেলুদা, কাকাবাবু পেরিয়ে টম সয়্যার আর এরফান নিয়ে পড়ে থাকতাম সারাদিন। বুঝতাম পড়ার টেস্ট বদলাচ্ছে। ঠিক ঐ সময়টাতেই আমার চারপাশ বদলে দিলো দুইটা পত্রিকা। রিডার্স ডাইজেস্ট আর রহস্য পত্রিকা। রিডার্স ডাইজেস্ট প্রথম পড়লাম স্কুলের লাইব্রেরিতে। আমার এক ক্লাস সিনিয়র যুবরাজ ভাই আমাকে টিফিন টাইমে লাইব্রেরীতে নিয়ে রিডার্স ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ এটা পড় ! নতুন অনেক কিছু জানতে পারবি’। সেদিন টিফিন টাইমে কতোটুকু পাঠ করতে পেরেছিলাম মনে নাই। তবে জাস্ট মাথা খারাপ হয়ে গেলো। এ তো অন্য দুনিয়া। আমি কোথায় ছিলাম এতোদিন? এরপরই ঘটলো সেই ঘটনা। আমাদের নারিন্দা গভঃ স্কুলের লাইব্রেরিতে রিডার্সের নতুন সংখ্যা পাওয়া যেতো না। টিফিনের টাকা বাচিয়ে ১৫ টাকা দিয়ে ভাড়া করে পড়তাম। পড়ে ফেরত দিলে ১০ টাকা রিটার্ন। কতো মজার আর আজব ঘটনা তথ্য যে জেনে ফেলেছিলাম। একবার রিডার্স পড়ে আমার ক্লাসের এক বন্ধুকে বললাম, ‘ জানিস আলকাতরা থেকে স্যাকারিন হয়’। আমার বন্ধু তখন স্কুলের গেটে আইসক্রিম খাচ্ছিলো। আমাদের স্কুলের গেটে তখন সাদা বরফের উপর বিভিন্ন রঙের সিরাপ দেয়া আইসক্রিম বিক্রি করতো। আইসক্রিম মামাকে সিরাপ দিতে দেখে আমি ভাবলাম স্যাকারিন নিয়ে রিডার্সের নতুন জ্ঞানটা ঝেড়ে দিই। আমার কথা শুনে আইসক্রিমটা মুখ থেকে বের করে আনিস খালি একটা কথাই বললো, ‘ ফাইজলামি করিস’। ভেবেছিলাম গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু না। আমার কপালে শনি আসলো। বিজ্ঞান ক্লাসে আনিস আমার নামে স্যারের কাছে বিচার দিলো। আমি নাকি ওর টিফিন খাওয়ার সময় আজেবাজে কথা বলেছি। আলকাতরা থেকে কি কখনো স্যাকারিন হয়? আবার সেটা আমরা খাই। এটা হতে পারে? আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষক আসাফোউদ্দলা স্যার আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি তো ভয়ে আধমরা। কারণ স্যারের বেতের বাড়ি ছিলো ভয়াবহ। তারচাইতেও ভয়াবহ হলো, সারা ক্লাস নিলডাউন করে রাখা ছিলো স্যারের প্রিয় শাস্তি।আমি ভয়ে ভয়ে বেঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে স্যারের সামনে দাঁড়ালাম। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, আমি এই তথ্য কোথায় পেলাম? ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম, রিডার্স ডাইজেস্ট। এটা বলার পর তিনি বিস্ময় নিয়ে বললেন, তুই রিডার্স পড়িস? আমি মাথা নাড়লাম। স্যার শুধু বললেন, যা বেঞ্চে গিয়ে বস। তারপর তিনি স্যাকারিন কিভাবে তৈরি হয় সেটা খুবই সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন। আর এরপর থেকেই ক্লাসে আমার নাম হয়ে গেলো ‘বৈজ্ঞানিক’।
আমি তিন বছর নারিন্দা স্কুলে পড়ি। ঐ তিন বছরই বন্ধুরা তো বটেই আমার শিক্ষকরাও আমাকে ডাকতেন বৈজ্ঞানিক বলে। এই ঘটানায় আমার একটা লাভ হলো। রিডার্সের ফিচারগুলেতে যা কিছু বুঝতাম না, সব স্যারের কাছে টিফিন টাইমে জিজ্ঞেস করতাম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, স্যার কোনোদিনই সেটা আমাকে একা টিফিনটাইমে বুঝাতেন না। নেক্সট ক্লাসে পড়া শুরুর আগে তিনি আমার প্রশ্নটা সবাইকে একসঙ্গে বোঝাতেন। স্যারের কাছ থেকে আমরা কতো কিছু জেনেছি! সসার, রোবট থেকে এলিয়ন অথবা উল্কাপাত থেকে ভ্যনিশিং কালার সবই আমাদের জানাতেন স্যার। পড়ার চ্যাপ্টারের বাইরে এই বিজ্ঞান জানা ছিলো আমাদের সবার প্রিয়। আর আমরাও বুঝতাম স্যার ক্লাসরূমে আমাদের এসব জ্ঞান দিয়ে দারুণ মজা পেতেন। একসময় রাগী এই বিজ্ঞান শিক্ষকটি শুধুমাত্র রিডার্সের জন্যেই আমাদের কাছে পাল্টে গেলেন। যে বিজ্ঞান পড়া না পারার জন্যে আমরা মারের ভয় করতাম, সেই আমরাই বিজ্ঞান ক্লাস করার জন্যে পাগল হয়ে যেতাম।
পুরোনো ঢাকা ছেড়ে আমি ধানমন্ডির একটা স্কুলে ভর্তি হই। বিসিএসআইআর স্কুল। সংক্ষেপে সায়েন্স ল্যাব স্কুল। স্কুলটা বিজ্ঞানের আবহাওয়ার মধ্যেই থাকতো বলে চারপাশে খালি বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা দেখতাম। পুরো এলাকাটাই একটা ল্যাব। সোলার সিস্টেম, বায়ো গ্যাস থেকে শুরু করে শাকসব্জীর বৈজ্ঞানিক চাষ সবই আমার স্কুলের আশেপাশে সায়েন্স ল্যাবের বিশাল সীমানা মধ্যে। শুধু তাই নয়, কেমিক্যাল জারে করে পিওনকে দেখতাম সায়েন্স ল্যাবের বড়ো স্যারদের জন্যে চা নিয়ে যেতে। আজব সব ব্যাপার স্যাপার । সেই স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক মুসলিম স্যার। স্যার বেশীরভাগ সময়ই স্যুট পড়তেন। আর হাতে থাকতো মেরুন রংয়ের একটা ব্রিফকেস। ক্লাসে বসতেন তার নির্ধারিত চেয়ার বাদ দিয়ে আমাদের পড়ার টেবিলের উপর। পড়া না পারলে বেতের বাড়ী যেমন দিতেন তেমনি আমাদের ভালোবাসতেন নিজের সন্তানের মতো। বিজ্ঞান বোঝাতেন গল্পের মতো। এত সহজ ভাষায় পড়া আমি আর কোনো স্যারের কাছ থেকে পাইনি। সবচাইতে বড়ো ব্যাপার হলো আমরা ক্লাসের বাইরে স্যারকে যেমন ভয় পেতাম ঠিক তেমনি ক্লাসে স্যারের মজার গল্প দারুণ এনজয় করতাম। ক্লাস টেনে আমাদের আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলা হলো। মুসলিম স্যার আমাকে বললেন, তুই প্রজেক্ট দে। আমি কাঠ, ম্যাচ বক্স আর মোটর দিয়ে একটা লিফট বানালাম। বিজ্ঞান মেলার আগের রাতে স্যার স্কুলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমার লিফটের কাজ দেখিয়ে দিলেন। আমার প্রোজেক্ট বিজ্ঞান মেলায় পুরস্কার পেলো। সবচাইতে খুশি আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষক মুসলিম স্যার। আমাকে জড়িয়ে ধরে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন সেদিন। যেনো তার সন্তান বিশ্বজয় করে ফেলেছে। এখন ঢাকা শহরে স্কুলের অভাব নেই। ইংরেজী স্কুল, বাংলা স্কুল, ভার্সন স্কুল, মাদ্রাসা মিলিয়ে হরেক মাধ্যম। আমি জানি না, এসব স্কুলে লাইব্রেরির ভুমিকা আজ কতোটুকু। ছাত্ররা আদৌ কী লাইব্রেরিতে যায়? পেপারব্যাক বই না হয় ব্যাকডেটেড, লাইব্রেরিতে কী তারা অনলাইন বই বা ম্যাগজিন পড়ে? ঢাকায় কি স্কুলের বাচ্চাদের জন্যে বিজ্ঞান মেলা হয়? কেমিস্ট্রি ল্যাবে কি ভ্যানিশিং কালার নিয়ে বাচ্চারা আনন্দে মেতে উঠে? বিজ্ঞান শিক্ষকদের কাছে কি তারা জানতে চায়, যেটা তাদের পাঠ্য বইতে নেই? মোবাইল, গ্যাজেট আর গুগলে আসক্ত এই প্রজন্ম তাদের শিক্ষকদের কাছে আসলে কিছুই জানতে চায় না। প্রশ্ন নেই তাদের কাছে। আছে শুধুই যুক্তি। যে যুক্তি নিমিষেই শিক্ষককে নিশ্চুপ করে দেয়। নির্বাক শিক্ষক আজ তাই বড়োই নিঃসঙ্গ এই শহরে। এ শহর আমার অচেনা লাগে এখন।
ছবিঃ গুগল