
উর্মি রহমান
লেখক, সাংবাদিক উর্মি রহমান প্রাণের বাংলার জন্য লিখছেন দূরের হাওয়া বিভাগে জীবনস্মৃতি; ‘মনে পড়ে’। তার শৈশব, কৈশোর জীবনের বয়ে চলা পথের গল্পগুলো এই ধারাবাহিক জুড়ে থাকব। উর্মি রহমান দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করেছেন। কাজ করেছেন বিবিসি বাংলা বিভাগেও। এখন বসবাস করেন কলকাতায়।
বিবিসির কাজ মানেই যে অফিসে বসে কাজ করা, তা নয়। সেখানে বাইরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ থাকতো। ব্রিকলেন সিরিজের কথা তো আগেই বলেছি। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নানা রকম অনুষ্ঠান বা উপলক্ষ্যে স্টেুডিওর বাইরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ ঘটেছে। একবার ব্রিটেনের রাণীর দ্বিতীয় এলিজাবেথের কন্যা রাজকুমারী অ্যান পূর্ব লন্ডনের একটি স্কুলে গেলেন। আমি সেখানে গিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য মালমশলা সংগ্রহ করলাম। তবে রাজকুমারীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ঘটেনি, কারণ তার জন্য বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। অন্যদের বক্তব্য নিয়েছিলাম। আর একবার পূর্ব লন্ডনের স্পিটালফিল্ডস’এর একটি কেন্দ্রে এক সোস্যাল ওয়ার্কারের বিবাহ-পূর্ব অনুষ্ঠান হবে, বাংলা বিভাগের প্রধান জন রেনার বললো সেখানে যেতে। গিয়ে খুব মজা পেয়েছিলাম।
যাঁর বিয়ে তিনি ইংরেজ, তাঁর সহকর্মীদের কেউ কেউ বাঙালী, তবে তাঁর কাস্টমাররা ৯০% বাঙালী। কনে সিলেটি ভাষায় বললেন, ‘আফা, আপনি আইছুইন, আমি খুব খুশি হইসি।’ পরে দেখা গেলো, আমি একমাত্র যে সিলেটি ভাষা বুঝলেও বলতে পারি না। কিন্তু সেদিনের অনুষ্ঠান খুব ভালো লেগেছিলো। বিলেতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বার্ষিক সম্মেলনেও আমাদের পাঠানো হতো। আমার খুব ইচ্ছা ছিলো, লেবার পার্টির সম্মেলনে যাবার, কারণ সেখানে তর্ক-বিতর্ক ও ভিন্ন মত থাকে, যা কনজারভেটিভ পার্টিতে হয় না। তাদের সম্মেলন অনেকটা স্টেজ ম্যানেজড্ বলে মনে হয় । কিন্তু আমার ভাগে জুটলো কনজারভেটিভ বা টোরি দলের কনফারেন্স। সেটা হয়েছিলো সমুদ্র তীরের শহর ব্রাইটনে। আমরা বিভিন্ন সেকশন থেকে অনেকে গিয়েছিলাম। বিলেতে এরকম একটি ঠাট্টা চালু আছে যে, পার্টি কনফারেন্সে রাজনৈতক দলের সদস্যদের চেয়ে বিবিসির সাংবাদিকদের সংখ্যা বেশী থাকে। সেখানে গিয়ে প্রথমবারের মত আমি টোরি দলের সদস্যদের মধ্যে উপমহাদেশের অনেককে দেখে অবাক হয়েছিলাম।
একজন বাঙালি মহিলাকেও পেয়েছিলাম, শাহওয়ার সাদিক। তাঁর সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম, সেই সঙ্গে ভারতীয় দু’জন ও আফ্রিকান একজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। আর একবার বাথ বিশ্ববিদ্যালেয় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। বিবিসি থেকে আরো দু’একজন ছিলেন। সেখানে গিয়ে আমার এক পুরনো পরিচিত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের কুর্টকে পেলাম যে এক সময় ঢাকায় ছিলো এবং আমার বাড়িতে আসত। একবার কাঁটা বেছে ইলিশ মাছও খেয়েছিলো। ঢাকায় একবার কুর্টকে জিনস’এর ওপর পাঞ্জাবী পরে বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে যেতে দেখে কারো কারো যীশুখৃষ্টের কথা মনে পড়েছিলো। যতদূর মনে পড়ে একটি ম্যাগাজিনেও সে সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিলো। যাহোক ওর সঙ্গে আবার দেখা হয়ে খুব ভাল লাগলো। আমরা দল বেঁধে রাতে বাইরে খেতে যেতাম। একদিন এরকম গিয়ে একটি রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
একটা লোক, সম্ভবতঃ বেকার হবে, কিছু গোলাপ ফুল নিয়ে কেনার জন্য পিড়াপিড়ি করতে লাগলো। আমি লোকটাকে জানালাম, আমি ফুল চাই না। লোকটা আর একজনের কাছে গিয়ে ফুল কেনার অনুরোধ করতে লাগলো। কুর্ট বললো, ‘তুমি গোলাপ কিনলে না কেন?’ আমি বললাম, ‘এসব গোলাপে কোনো গন্ধ নেই।’ কুর্ট বাংলায় বললো, ‘গন্ধ বলছো কেন? বলো সুগন্ধ।’ বিদেশীরা যখন বাংলা শেখে, তখন একেবারে শুদ্ধ বাংলা শেখে। তবে ওর কথা শুনে বেশ মজা পেয়েছিলাম। এ ধরনের বেশ কিছু কাজ বুশ হাউজের স্টুডিওর বাইরে গিয়ে করেছিলাম। সেটা ভালই লাগতো। তবে বাংলাদেশ থেকে গণ্যমান্য ব্যক্তি এলে তাঁদের সাক্ষাৎকার নিতে হতো, সেটা সবসময় ভাল লাগতো, এমন কথা বলতে পারবো না। বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী ঘন ঘন লন্ডন যেতেন আর আমাকে বলা হতো তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে। কিন্তু প্রায় প্রতি মাসে কারো সাক্ষাৎকার নিলে বিষয় তো ফুরিয়ে যাবেই। একবার প্রত্যাখ্যান করায় সিনিয়র সহকর্মী, যিনি এই অনুরোধ করতেন, তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমার কিছু করার ছিলো না।
অবশ্য কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম, তার মধ্যে দু’জন হলেন, যশোধরা বাগচী আর নবনীতা দেবসেন। পরবর্তীতে কলকাতা বসবাস করতে এলে তাঁদের সঙ্গে আবার দেখা ও ঘনিষ্ঠতা হয়। বিশেষ করে যশোধরাদি পরম স্নেহে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তাঁরা দু’জনেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তবে যশোধরাদির স্বামী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমিয় বাগচীর সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে। আর আমার আর সাগরের সৌভাগ্য, তাঁর কাছ থেকেও অপার স্নেহ পাচ্ছি।