কত স্মৃতি যে এক জীবনে আগলে রাখি! দাড়ি কামাতে গিয়ে ১৯৮৪ সালে একবার গাল কেটে রক্তারক্তি, স্কুল ছুটির পরেও নিলডাউন হয়ে থাকা, গোপনে সিগারেট খাওয়া, শুভঙ্কর কবে নন্দিনীকে প্রেম নিবেদন করেছিল, কবে অনেক বৃষ্টির ভেতরে গা্ন গেয়ে পাগলের মতো ঘুরে বেড়ানো, কবে খুব একলা হয়ে থাকা-মনে পড়ে। মনের মধ্যে একটা গাছভর্তি পাতার শরীর কেঁপে ওঠে সুনীলের সেই কবিতার লাইন পড়ে-একলা ঘরে শুয়ে রইলে কারুর মুখ মনে পড়ে না / মনে পড়ে না, মনে পড়ে না, মনে পড়ে না, মনে পড়ে না / চিঠি লিখব কোথায় কোন মুণ্ডহীন নারীর কাছে ?/ প্রতিশ্রুতি মনে পড়ে না, চোখের আলো মনে পড়ে না / ব্লেকের মতো জানলা খুলে মুখ দেখব ঈশ্বরের?’(অসুখের ছড়া)।
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে কখেনও বসতে ইচ্ছে করে কারো। সময় আর জীবন যাপনের আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত মন ফিরে দেখতে চায় সুসময়। তখন শৈশব, কৈশোরের নির্ভার সময় চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। মানুষ সেই স্মৃতির ঝাঁপি যত্নে আগলে রাখে একদিন ফিরে তাকাবে বলে। এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো সেই স্মৃতি নিয়ে ‘স্মৃতি আগলে’।
প্রতি মুহুর্তে ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছায় আমরা যা দেখি, যেসব শব্দ শুনি, যেসব জিনিস স্পর্শ করি কিংবা স্বাদ নেই, সরল কথায় আমাদের পাঁচ ইন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে আসা যে কোন তথ্য স্নায়ু থেকে সংকেত হিসেবে যায় মস্তিষ্কে। তথ্য আসছে, এটুকু বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে মুহুর্তের মাঝে আমাদের মস্তিষ্ক তথ্যগুলোকে জমা করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায় এবং বেশীরভাগ তথ্যই সে জমা করে রাখে। কোন কিছুর দিকে মুহুর্ত খানিকের জন্যে তাকিয়ে কিংবা স্পর্শ করে কিংবা আবছাভাবে কিছু শুনে জিনিসটি দেখতে কেমন বা শুনতে কীরকম, সেটি মনে রাখার যে ক্ষমতা- এটিই হলো ইন্দ্রিয়গত স্মৃতি। এটি একটি স্বয়ংক্রিয় এবং অবচেতন প্রক্রিয়া। অর্থাৎ কিছু একটা দেখার পরে কিংবা শোনার পরে- অর্থাৎ তথ্যগুলো মস্তিষ্কে আসার পরে কোন স্মৃতিটি ইন্দ্রিয়গত স্মৃতিতে জমা হবে এবং কোন একটি স্মৃতি ঠিক কত সময়ের জন্যে ইন্দ্রিয়গত স্মৃতিতে জমা হয়ে থাকবে, তা মানুষের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে না।
আমরা ভাবি। কতকিছু ভাবি। ভাবতে ভাবতে দিন যায়। কে কবে উঠানে বাতাবিলেবুর গাছের গায়ে সাইকেল ঠেস দিয়ে রেখে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় চলে গিয়েছিলো সে এখন স্মৃতি; নিজের মনের কাছেও হয়তো সে আজও উদ্ধাস্তু। তবুও তার কথা ঘুরে আসে মনের ভেতরে। স্মৃতির হাওয়া কোন কার্তিক মাসে ঘর পালানো স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়? কে পালিয়ে যায়? তারপর শুধু মাঠ ঘাট, বন ভাঙতে থাকে?কোনোদিন আর ফিরে আসে না! সেই ফেলে যাওয়া সাইকেলটার স্মৃতি অনেকদিন আগলে রেখেছিলো কেউ। বহুদিন বাতাবিফুল ঝরে পড়েছে উঠনে, হাওয়ায় উড়ে গেছে; কেউ সাইকেলটা নিতে ফিরে আসেনি। স্মৃতি এমনই হয়। এমনই আচমকা মনের মধ্যে একটু একটু করে গড়ে তোলা তার রহস্যময় রাজত্ব ছেড়ে উঠে আসে। আমাদের মনে পড়িয়ে দেয়।
বহুদিন আগে পড়া একটা কবিতার লাইন ঘুরেফিরে মনে পড়ে-স্মৃতি যেন কোনো অবলুপ্ত স্থাপত্যের জলমগ্ন সিঁড়ি। চোখ মেলে যেন দেখতে পাই এক পুরনো দালান; সিঁড়ি নেমে গেছে সবুজ অন্ধকারে। সেখানে জল থই থই। সব হারিয়ে গেছে যেন। তবু ঠিক খুঁজে পাওয়া যায়। একটা মৃত অথচ সম্পূর্ণ ছবি দক্ষ গোয়েন্দার মতো অনুসরণ করতে থাকে। আচ্ছা, কেন আমরা কোন কিছু ভুলে যেতে চাইলে সেটা কিছুতেই ভুলে যেতে পারি না? এই প্রশ্নের উত্তরও একটাই। যতবার একটা স্মৃতিকে ভুলে যেতে গিয়ে আমরা সেটার কথা মনে করছি, ততবার সেই স্মৃতিটা আরো শক্তিশালী হচ্ছে। কাজেই, ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে কোনকিছু ভুলে যাওয়া আসলে সম্ভব না। কবি সিলভিয়া প্লাথ তাঁর ‘বেলজার’ উপন্যাসে লিখেছেন, ‘ভুলে যাওয়াটা তার কাছে বোবা তুষারের মতো। কিন্তু ওই তুষারে ঢেকে যাওয়াটাই তার কাছে আশার প্রান্তর’। কাকে ভুলে থাকতে চায় মানুষ? আদৌ কি ভুলে যাওয়া যায়? চিকিৎসকরা বলেন, ডিমেনশিয়া রোগের কথা। ল্যাটিন শব্দ ডেমেনটারে থেকে উদ্ভুত ডিমেনশিয়া, যার অর্থ পাগল করে দেয়া। স্মৃতিভ্রংশ রোগ এই ডিমেনশিয়া। আক্রান্ত ব্যক্তির বুদ্ধি, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব লোপ পায় এবং রোগ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিতে নিতে মানুষের স্মৃতি হারিয়ে যেতে থাকে। মনের জগতে ঘোষিত হয় নির্বাসন দণ্ড। সেই সাইকেল, জলমগ্ন সিঁড়ি, কবিতার লাইন, কবে পড়া বইয়ের নাম, মানুষের মুখ হারিয়ে যায় এক কুয়াশার রাজ্যে।
কিন্তু সব স্মৃতিই কি ভুলে যাওয়ার? শুভঙ্কর আর নন্দিনীর ভালোবাসার গল্প লিখতে ভোলেননি কবি পুর্নেন্দু পত্রী।কবে পথে ধাওয়া করেছিলো বেপরোয়া বৃষ্টি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতো কোন মুণ্ডুহীন নারীকে চিঠি লিখেছিলাম মনে রয়ে গেছে। সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে শর্মীলা ঠাকুরের উত্তমকুমারকে বলা সেই সংলাপ মনে পড়ে, ‘মনে রেখে দেবো।’ একটা গল্পের স্মৃতি, একটা সিনেমার স্মৃতি মনের মধ্যে অবিকল থেকে যায় কখনো কখনো। সেসব বড্ড যত্নের স্মৃতি। সিনেমার গল্প আরও বেশি সিনেম্যাটিক জীবনের গল্পে সত্যি হয়ে থাকে, থাকে স্মৃতি। একটা সত্যি কাহিনি দিয়ে লেখার ইতি টানা যাক-
এক চিলতে ঘরে ইজিচেয়ারে শুয়ে, অভিমানী বাউল জর্জ বিশ্বাস। কেবলই স্মৃতির অতলে হারিয়ে যান। মাঝে মাঝে সব অর্থহীন মনে হয়। তাঁর সঙ্গে কলকাতার নৃত্যশিল্পী মঞ্জুশ্রীর এক অদ্ভুত সম্পর্কের স্মৃতি রয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়।
দু’জনের দেখা হয় সেই ১৯৫২ সালে। মঞ্জুশ্রী চাকী তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী। এলিট সিনেমা হলের অনুষ্ঠানে দেবব্রত বিশ্বাস প্রথম দেখলেন তাঁকে। সেদিন তিনি গেয়েছিলেন আর মঞ্জুশ্রী নেচেছিলেন। পঞ্চাশের দশকে কলকাতা শহরে বহু অনুষ্ঠানে দেখা যায় তাদের দু’জনকে। দেবব্রতর গান আর মঞ্জুশ্রীর নৃত্য। জোর গুজব রটলো কলকাতার পথের হাওয়ায়। মোটরবাইকে করে তখন শহর চষে ফেলছেন মঞ্জুশ্রী-জর্জ। বিয়ে হয়ে যায় মঞ্জুশ্রীর।
বিয়ের কিছু দিন পর বিদেশে চলে গেলেন। তারপর যখনই কলকাতায় এসেছেন, দু’জনে অনুষ্ঠান করেছেন।
পরে, অনেক পরে মঞ্জুশ্রী নিজেও খুব কাছের জনদের বলেছিলেন সেই-সব রটনার দিন-রাত্রির কথা।
মঞ্জুশ্রীর মেয়ে হওয়ার খবরে ১৯৬৩-র মার্চে দেবব্রত বিশ্বাস তাঁকে চিঠি লিখছেন, ‘তোমার মা হওয়ার খবর শ্রীকান্তের মুখে আমি পেয়েছিলাম। … আমার সাড়াশব্দ নেই কারণ আমি নিজেই নেই— যদি দেশে ফেরো, আমায় চিনতে তোমার খুব অসুবিধে হবে— হয়তো পারবে না। বেলা আমার ফুরিয়েছে— তাই খেলাও শেষ।’
দেশে ফিরে আমৃত্যু মঞ্জুশ্রী দেবব্রত বিশ্বাসের গানকে আশ্রয় করে বেঁচে ছিলেন। স্মৃতি সত্যিই এক আশ্চর্য ষড়যন্ত্র।
ইরাজ আহমেদ
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা