
স্বরূপ জাহিদ (লেখক)
তখন বোধহয় রাত ন’টা। গুলশান আবাসিক এলাকায় শুনশান নীরবতা। আমরা তিন বন্ধু পত্রিকার একটা কাজ সেরে ফিরছি। নির্জন ফুটপাতে আচমকা হাঁটা থামিয়ে বন্ধু সুমন পাটোয়ারি দাঁড়িয়ে পড়লো। তার এই হঠাৎ ব্রেকে আমি আর ওমর ও থমকে গেলাম। আসলে না দাঁড়িয়ে উপায় নেই। আমাদের একদম উল্টোদিকে এক আলিশান বাড়ি। তা আলিশান বাড়ি গুলশানে থাকতেই পারে। এটা তো অবাক হওয়ার মতো কোনো ঘটনা না। আমাদের আসলে ধাক্কাটা দিয়েছে একটা ঝাড়বাতি। বিশাল বাউন্ডাড়ির ঐ পাশে আলিশান সেই বাড়ি থেকে ঝাড়বাতির আলো যেনো পুরো রাস্তাজুড়ে এক অপার্থিব জগত তৈরি করেছে। ডুপ্লেক্স সেই বাড়ির সামনের অংশ পুরোটাই কাঁচের। বাড়ির দোতলার ছাদ থেকে সেই অনিন্দ্য সুন্দর ঝাড়বাতিটি একদম নিচতলা পর্যন্ত নেমে এসেছে। আর তার আলো সেই ঝকঝকে কাঁচ ভেদ করে দ্যুতি ছড়িয়েছে রাস্তা পর্যন্ত। আমরা হাঁটা ভুলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম সেদিন অনেকক্ষণ।
প্রায় আড়াই দশক আগে ঢাকা শহরের একটা বাড়ি আমাদের মতো তিন আধুনিক তরুনের হার্টবিট বন্ধ করে দিয়েছিল। ম্যাচবাক্সের মতো খোপ খোপ ঘরবাড়িতে পূর্ণ এই শহরে সেই বাড়িটি আজ আর নেই।সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে ঝাড়বাতিটিও। শুধুমাত্র বাড়িটির প্রতি আগ্রহ থেকেই আমরা পরে জেনেছিলাম বাড়িটি কার। বিত্তবান সেই মানুষটিকে শহরের সবাই চেনেন। ঢাকার অভিজাত এলাকায় তার এরকম বাড়ি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এই নগরের বাসিন্দারা একসময় জানতেন, এরকম ডুপ্লেক্স বা ‘সতন্ত্র বিলাসী’ বাড়ি ঢাকার গুটিকয়েক বিত্তবানদের-ই আবাসস্থল। তারা বাস করেন তাদের আভিজাত্য আর রুচি নিয়ে এ শহরে। আশি বা নব্বইয়ের দশকে এ শহরে অনেক অভিজাত, রুচিশীল বাড়ি ছিলো। এপার্টমেন্ট, কন্ডমোনিয়াম নয়, আক্ষরিক অর্থেই বড়ো সতন্ত্র বাড়ি। কখনো সেটা ডুপ্লেক্স বা ট্রিপ্লেক্স আবার কখনোবা সেটা ছিমছাম একতলা বাসা। বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা এক বিঘার প্লটে এসব বাড়ি পরিচয় করিয়ে দিতো সে সময়ের অর্থবান মানুষদের। তাদের রুচি আর আভিজাত্য প্রকাশ পেতো বাড়িগুলোর নকশা আর পরিচর্যায়।
ঢাকা শহরের নির্দিষ্ট স্থানেই এসব বাড়ির দেখা মিলতো বেশী। গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, রাংকিন স্ট্রিট, লারমিনি স্ট্রিট আর মোহাম্মদপুরের কিছু অংশ জুড়েই ছিলো এমন সব বাড়ির ঠিকানা। সবুজ ঘাসের লন, বড়ো গ্যারেজ আর বাউন্ডারির চারপাশ ঘিরে বড়ো বড়ো গাছ তো থাকতোই, আরো থাকতো বিভিন্ন ডিজাইনের পানির ফোয়ারা। প্রায় বিকেলেই বাড়িগুলোর লনে থাকতো চা খাওয়ার আয়োজন। বাড়ির কর্তা তার পরিবারের সংগে তো চা খেতেনই, আয়োজন করতেন বন্ধুবান্ধবের জন্যে টি পার্টির। বাড়ির লন জুড়েই চলতো জমাট সেই আড্ডা। এ শহরে একসময় মানুষ দিয়েও বাড়ি চেনা যেতো।
ঢাকা তখন নিতান্তই ছোট একটা শহর। আমি তখনো স্কুলের গন্ডি পেরুইনি। আমরা বন্ধুরা মিলে গোটা ঢাকা শহর চষে বেড়াতাম। রাংকিন স্ট্রিট থেকে গুলশান বা ধানমন্ডি থেকে বনানী সবখানেই ছিল আমাদের অবাধ যাতায়াত। যেহেতু থাকতাম পুরান ঢাকায়, তাই সেখানকার বনেদি এলাকা ওয়ারী, রাংকিন স্ট্রিট , ওয়্যার স্ট্রিট, লারমিনি স্ট্রিটের বিলাসবহুল বাড়িগুলোর কর্তা কারা তা লোকমুখে জেনেই বড় হয়েছি। উদাহরন দিই। বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শবনমের বাবা ননী বসাক যিনি একদা ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবলের রেফারী ছিলেন, তাঁর বাসা ছিলো ওয়ারীতে। এছাড়া শিল্পী কামরুল হাসানের বাড়ি আর ড. নন্দীর বাড়ি ছিলো রাংকিন স্ট্রিটে। এছাড়া প্রখ্যাত সাহিত্যিকে বুদ্ধদেব বসু এবং নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ আমর্ত সেনও থাকতেন ওয়্যার স্ট্রিট এবং ওয়ারীতে তাদের নিজস্ব বাড়িতে কোলকাতায় প্রস্থানের আগে। এছাড়া চলচিত্র পরিচালক সুভাষ দত্তের বাড়িটিও ছিলো পুরোনো ঢাকার এই বনেদি এলাকাতেই। এভাবেই তখন আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো কোনটা কার বাড়ি। ধানমন্ডিতে সালমান এফ রহমানের বাসা, বসুন্ধরা গ্রুপের সোবহান এর বাসা, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসা, গুলশানে ট্রান্সকমের লতিফুর রহমানের বাসা অথবা রাংগস গ্রুপের রউফ চৌধুরীর বাসা, আব্দুল আউয়াল মিন্টুর বাসাও ছিলো খুবই পরিচিত। একইভাবে বনানীতে আনিসুল হকের বাসাও ঢাকাবাসীর চেনা ছিলো। এসব সতন্ত্র অভিজাত বাড়িগুলো পরিচিত হয়ে উঠেছিল তার ভু-স্বামীদের নিজস্ব স্বকীয়তায়। রুচি এবং নান্দনিকতার মিশেলে এসব বাড়ি ঢাকা শহরকে যেনো আভিজাত্যের পালক লাগিয়েছিলো।
আজ আমাদের ঢাকা মেগাসিটি। শানৈ শানৈ উন্নতি হচ্ছে এ শহরের। আলো ঝলমলে এ শহরে এপার্টমেন্ট, কন্ডোমোনিয়াম, প্রিমিয়াম ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট বা পেন্টহাউস তরতরিয়ে ডালপালা ছড়াচ্ছে। তবে ঐ যে, সবই হচ্ছে ম্যাচবাক্সের ভিতরে। লন আর সুইমিংপুলও ঢুকে পড়ছে এই ইটের বাক্সে। ছিমছাম দোতলা অভিজাত বাড়িগুলো হারিয়ে গিয়ে আজ সেখানেই এসব ইটের বাক্স গড়ে উঠছে। ইদানীং গুলশান বা বনানীতে সুউচ্চ অফিস বিল্ডিং আর এপার্টমেন্টের ভীড়ে অভিজাত বাড়ি চোখেই পড়ে না। পৃথিবীর প্রায় সব শহরে বিত্তবানদের নিজস্ব বাড়ী থাকে একটি নির্দিস্ট এলাকাতে। আমাদের শহরেও একসময় ছিলো। এখন সেটা হারিয়ে যেতে বসেছে। হয়তো বিত্তবানদের সংখ্যা বেড়েছে এ শহরে। যারা বনেদি বিত্তবান তারাই কিছু বাড়ি এখনো টিকিয়ে রেখেছেন। দুর্নীতি আর কালো টাকার অবাধ ছড়াছড়ির এ শহরে অজস্র নতুন বিত্তবানদের জন্যে তাই এ শহরে সতন্ত্র বাড়ি নয়, আছে প্রিমিয়াম এপার্টমেন্ট। আছে শেয়ারে ব্যবহারের জন্যে সুইমিংপুল, জিম আর লন। এ শহর তাদের বিত্ত দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু দিতে পারেনি একক বাড়ির বনেদিয়না। আর তাই বদলে যাওয়া এ শহর হারিয়েছে তার আভিজাত্য।
এ শহর আমার অচেনা লাগে এখন।
ছবিঃ গুগল