পোড়াবো তাজমহল…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 9 Jun 2022

345 বার পড়া হয়েছে

Shoes

কবি ত্রিদিব দস্তিদারকে আমার মাঝে মাঝে মনে পড়ে। পুরানা পল্টনের গলিতে কোনো কোনো বৃষ্টির দুপুরে একা হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে, লুপ্ত দৈনিক বাংলা পত্রিকার বিশাল ভবনটার সামনে দিয়ে পথ অতিক্রম করলে কবি ত্রিদিব দস্তিদারের স্মৃতি এক ঝলক আমাকে চমকে দেয়। কখনও এই শহরে গুটিয়ে ফেলা কোনো নির্দিষ্ট বইয়ের দোকানের পথ ধরে যাবার সময় মনে পড়ে কবিকে। পরনে চাপা জিন্স প্যান্ট, ঝলমলে শার্ট, কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে ওই চলেছেন কবি; গালে এলোমেলো দাড়ি, মুখে উজ্জ্বল হাসি। এই শহরে একদা কবিরা এমনই ছিলেন।। কী উজ্জ্বল! কী প্রাণবান! বহু বছর আগে কাউকে বিদায় দিতে বিমানবন্দরে গিয়েছি। সেখানেই কবির সঙ্গে প্রথম দেখা। দৈহিক অবয়বে ছোটখাট মানুষ ত্রিদিব দস্তিদার সেদিন খুব উজ্জ্বল বাটিক প্রিন্টের শার্ট পরেছিলেন আর হা হা করে হাসছিলেন। সঙ্গে ছিলেন কবি ফজল শাহাবুদ্দিন। কেন হুট করে দেখা হয়েছিলো তাঁর সঙ্গে, তিনি কেনো সেদিন বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন একেবারেই মুছে গেছে স্মৃতি থেকে। কিন্তু সেই উজ্জ্বল মানুষটিকে ভালো লেগে গিয়েছিলো। ত্রিদিব দস্তিদারের মুখশ্রী ছিলো অনেকটা স্প্যানিশ জলদস্যুদের মতো। কবিতায় তো জলদস্যুদের প্রধান্য থাকে বলে মনে হয়।

ত্রিদিব দস্তিদারের সঙ্গে আমার আবার দেখা অনেকগুলো বছর টপকে সাংবাদিকতা পেশায় এসে।ততোদিনে তিনি ত্রিদিব’দা হয়ে উঠেছেন। দেখা হলেই হাসি, আড্ডা আর কবিতা কলকল করে ওঠে। ‘তোমাকে ডাকতে হলে ব্যাঘ্র পাঠাতে হয়’ ত্রিদিব’দা লিখেছিলেন এমন প্রেমের কবিতা। তখন শহরে কয়েন বক্স ফোন চালু হয়েছে। বাঘমার্কা সিকি ফেলে কল  করতে হতো সেই পাবলিক ফোনে। চমকে উঠেছিলাম লাইনটা শুনে।

অকৃতদার ছিলেন ত্রিদিব দস্তিদার। থাকতেন ঢাকা শহরের গোপীবাগ এলাকায় একা একা। কাঁধে ব্যাগ ফেলে ত্রিদিব’দাকে দেখতাম কখনও রিকশায়, কখনও পায়ে হেঁটে চলেছেন। বহুদিন আমরা বায়তুল মোকাররমের মোড় থেকে আড্ডার চিনাবাদাম ভাঙতে ভাঙতে হেঁটে গেছি স্টেডিয়াম পাড়ায় সেই বিখ্যাত বইয়ের দোকান ম্যারিয়েটায়। আমাদের হাসি আর গল্পগুলো কি আজও ভেসে আছে স্টেডিয়াম পাড়ার বাতাসে?

ত্রিদিব’দার কথা আমার অনেকদিন পর মনে পড়লো। কেন? আমরা তো আজকাল ত্রিদিব দস্তিদারকে মনেই করতে পারি না। এই শহর থেকে হারিয়ে গেছে তার হো হো হাসি, কবিতাগুচ্ছ, রঙচঙে পোশাক আর মাঝে মাঝে সানগ্লাসে ঢাকা চোখ। কোনোদিন সন্ধ্যাবেলা সন্ধানী পত্রিকার অফিসে ক্রিদিব’দার আগমনে হৈ হৈ করে ঝাল মুড়ি খাওয়া, কখনও সাপ্তাহিক রোববার অফিসের সিঁড়িতে দেখা-

লেখা দিলেন কবি? আরে কোথায় চললেন? চা খাবো তো।

আজকে কাজ আছে ত্রিদিব’দা, আরেকদিন।

এড়িয়ে গেছি হয়তো।

পুরানা পল্টনে দৈনিক সংবাদ অফিসের গলিতে বৃষ্টির মেঘ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন একদিন ত্রিদিব’দা। রিকশা থেকে নামতেই হাতে ধরিয়ে দিলেন এক কপি কবিতার বই ‘ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেবো’। ফতুর করে দেয়া শব্দটা সেই বৃষ্টি আসি আসি দিনে কতক্ষণ যে আমাদের মাঝখানে ঘুরে বেড়ালো! নিজেই হাসতে হাসতে প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা, ভালোবেসে কেউ ফতুর হয় বলেন তো?

আপনি তো ভালোবেসে একা একা ফতুর হয়েই চলে গেলেন ত্রিদিব’দা।ছয়টা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিলো আপনার। আমার মনে পড়ে আপনাকে। এই শহরের সাহিত্য সভা, কবিদের সমাবেশ, দল আপনাকে ভুলে গেছে। আমি শুধু মাঝে মাঝে বোকার মতো পুরানা পল্টনে, দৈনিক বাংলা অথবা ইত্তেফাক ভবনের সামনের রাস্তায় খুঁজি আপনাকে। ভিড়ের ভেতরে উজ্জ্বল এক কবি, ‍যিনি তাজমহল পোড়াতে চেয়েছিলেন কবিতায়।

ইরাজ আহমেদ
ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199