বয়সের সংগে মনে হয় রুচি বদলায়। একসময়ের অসম্ভব প্রিয় চাইনিজ খাবার, আজ আর আমাকে টানে না।এটা কি আমার বয়সী জিভের দোষ, নাকি সময়ের সঙ্গে রেসিপি, রাঁধুনি, রেঁস্তোরা আর ঢাকার বদলে যাওয়া সময়টা দায়ী, সেই প্রশ্নগুলো সকাল থেকে মাথার মধ্যে ঘুরছিলো। তা না হলে, আমার এতো প্রিয় চাইনিজ খাবার আজ কেনো হাজারো বিদেশী খাবারের রেঁস্তোরায় ঢেকে যাওয়া এই শহরে বড়োই মলিন? আমার প্রথম চৈনিক রান্নার স্বাদ গ্রহণ এই শহরেই এক রেস্তোরাঁয় সময়টা আশির দশকে শুরুর দিকে। মনে হয় ক্লাশ ওয়ান অথবা টু তে পড়ি। রেস্তোরাঁর নাম ম্যান্ডারীন সম্ভবত। ঢাকার পল্টনের মোড়ে ছিলো রেস্তোরাঁটা। তখন ঢাকা অনেক ফাঁকা আর ছোট্ট শহর। প্রাইভেট গাড়ি, উবার বা সিএনজি‘র দাপট নেই। রিক্সাতেই চলাচল সবার। মনে আছে, রিক্সায় চড়েই বাবা মায়ের কোলে বসে নেমেছিলাম ম্যান্ডারিনের গেটে। কোনো উপলক্ষ্য ছিলো কিনা সেটা আর মনে নেই। তবে এখনো স্মৃতি হাতড়ে যেটা পাই, তা হলো, একটা অনেক পুরোনো টানা বারান্দা দেয়া বড়ো বাড়ির মধ্যে ছিলো রেস্তোরাঁটা। বিশাল হলুদ রংয়ের বাউন্ডারি দেয়ালের সামনে বড়ো লন। লন পেরুলেই বড়ো দুইটা লাল রংয়ের চায়নীজ লন্ঠন জ্বলছে। রেঁস্তোরার গেট দিয়ে ঢুকতেই একটা গন্ধ পেলাম। সয়া সস, আর চিকেন স্টকের হাল্কা ঘ্রাণ। সেদিন কী খেয়েছিলাম, আজ আর মনে নেই। তবে সেই গন্ধটা এখনো পাই। মগজে গেঁথে আছে। অথচ আজ ঢাকা শহরের কোনো চাইনিজ রেস্তোরাঁতে আমি আর এই গন্ধটা পাই না।
ঠিক একই গন্ধটা ছিলো হোয়াং হো নামের রেস্তোরাঁতেও। পরীবাগের মোড়ের কাছে সেই চীনা খাবারের দোকানটা আর নেই। সেখানেও গিয়েছিলাম সেই আশির দশকেই, আমার খালার পরিবারের সংগে। মনে আছে, কাপড়ের ন্যাপকিন গলায় ঝুলানোর সিস্টেম আর গরম চায়নীজ স্যুপে বিভিন্ন অনুষঙ্গ মেশানোর কায়দা শিখেছিলাম ঐ দোকানেই। আজ এই শহরে বেশীরভাগ চীনা খাবারের রেস্তোরাঁয় কাপড়ের ন্যাপকিনের বদলে টিস্যুর ন্যাপকিনের প্রচলন হয়েছে। আর চাইনিজ স্যুপের বদলে শুধুই থাই স্যুপ। তাও আবার বাঙালি স্টাইলে রান্না। টিস্যু ন্যাপকিন আর থাই স্যুপ আজ হটিয়ে দিয়েছে সেই বনেদিয়ানা।
আরেকটা রেস্তোরাঁ আমার এই শহরে খুব প্রিয় ছিল। মিং হাউস। দুই চীনা দম্পতি মিলে ধানমন্ডি আট নম্বরে চালাতেন রেস্তোরাঁটা। আমার জীবনে খাওয়া সেরা ফ্রায়েড রাইস ছিলো মিং হাউসের। নব্বুই দশকের আগেই রেঁস্তোরাটা বন্ধ হয়ে যায়। আশির শেষ ভাগে ঢাকায় খুবই জনপ্রিয় হয় চাং পাই রেস্তোরা। তাদের শ্লোগান, ‘চল যাই, চাং পাই’ মানুষের মুখে মুখে ফিরতো সেই শ্লোগান। আমার মনে আছে, আমরা খেতে গিয়েছিলাম এবং খেয়ে হতাশ হয়েছিলাম। অন্যগুলোর মতো ভালো লাগেনি। অনেক পরে বুঝেছিলাম, চাংপাই রেস্তোরা দিয়েই ঢাকা শহরে বাঙালি চাইনিজ রান্নার যাত্রা শুরু হয়। খুব সম্ভবত আগে যে রেস্তোরাঁগুলো চীনা কায়দায় রান্না করতো, চাং পাই-ই প্রথম সেটা বদলে দেয়। অথেনটিক চাইনিজ রেসিপির বদলে শুরু হয়, বাংলা স্টাইলের রান্না। সেই রেসিপিতেই ছেয়ে গেছে আজ এই ব্যস্ত ঢাকার সব চীনা খাবারের দোকান। ক্যান্টন আর সিসিলি চাইনিজও সেই সময়ে অনুসরন করেছে চাংপাইর দেশীয় রেসিপি। আর ঢাকাবাসীর অভ্যস্ততায় পরিণত হয়েছে এ ধরনের স্বাদ।
নব্বুই দশকের কথা না বললেই নয়। আমরা তখন কৈশোর পেরুচ্ছি। পকেটে টাকার সল্পতার কারনে বন্ধুরা মিলে খুঁজতাম কোথায় কম দামে চাইনিজ খাবার মিলবে। মাত্র ৫০ টাকা চাঁদা তুলে আমরা বন্ধুরা খেতে যেতাম বাং চিন রেস্তোরাঁতে। বলাকা সিনেমা হলের দোতলায় সেই রেস্তোরাঁটা আমাদের খুব প্রিয় ছিলো। ফ্রায়েড চিকেনটা দারুন করতো ওরা। নব্বুইয়ের শেষ প্রান্তে যখন জীবনে রোমান্স এলো, তখনো কম দামে এসব খাবার খেতে যেতাম এলিফ্যান্ট রোডের ডাক নামের রেস্তোরাঁটায়। আলো আঁধারে মাখা সেই রেস্তোরাঁর নিভৃতি স্বাভাবিকভাবেই প্রিয় ছিলো আমার।
আজ সব রেস্তোরাঁ বড্ড আলো ঝলমলে। এখনকার তরুন তরুনীদের মনে হয়, আলো আধার পছন্দ না। অথবা তারা ভালোবাসার জন্যে এখন অন্য কোনো জায়গা নিশ্চয় খুঁজে নেয়। আজ এই শহরে কাটাবন এলাকার টুংকিং নেই, ধানমন্ডির সাংহাই নেই, চুংকিং নেই, ম্যাগডোনাল্ডস নেই, গুলশানের লেমন গ্রাস নেই, আ্যসপারাগাস নেই, উত্তরার কিনারি নেই, বনানীর সেহনাই নেই, ইস্কাটনের চপস্টিক নেই ।এরকম আরো কতো চীনা খাবারের দোকান হারিয়ে গেছে তাদের রান্না, রেসিপি আর আলো আঁধারের আয়োজন থেকে। এই শহরে তাই চাইনিজ খাবার আমাকে আর আকর্ষণ করে না। এই শহর-ই যে আমার অচেনা লাগে এখন।
ছবিঃ গুগল
স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।
সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।
Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]
Phone: +8801818189677, +8801717256199