শীতের খোঁজে...

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 19 Oct 2023

4550 বার পড়া হয়েছে

Shoes

সেবার মানে বেশ অনেক বছর আগেকার কথা। অনেকে মিলে খুব ভোরবেলা শহরকে পরিত্যাগ করে শীতের খোঁজে বের হয়ে যাওয়া। শীতের খোঁজ কেমন? ভাববেন না, ভ্রমণ কাহিনি বলতে বসিনি। সেবারও আশ্বিন মাসের শুরুতে খুব গরম। কেউ খবর দিয়েছিলো, সিলেট জেলায় বৃষ্টি ঝরছে অবিরল। শীত ছড়িয়ে পড়ছে ওদিকের মাঠে মাঠে। তাই হুট করে এক ভোরে কয়েকজন মিলে চায়ের সরঞ্জাম, বড় সাইজের নোনতা বিস্কুট, বাদাম, ফল আর বোতলবন্দী অমিয় গরল গুছিয়ে নিয়ে একটা গাড়িতে একটু চাপাচাপি করে বসে বের হয়ে পড়া।সে কেমন এক শীতের খোঁজ! জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘‘এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে’’। সেরকম কোনো গভীর শীতের খোঁজ আমাদের ভাবনায় ছিলো না।যাত্রীদের মাথায় ঘুরছিলো ঝমঝম করে বৃষ্টি, ঠাণ্ডা রাত্রি আর শেষ রাতে হালকা কুয়াশায় জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা চা বাগান। বড়জোড় কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর মতো কোনো এক সুপর্ণার কাছে গিয়ে জানতে চাওয়া- শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা?

শীতকাল কবে আসে আসলে? ভাদ্র মাসেই লঘু চাপ, নিম্ন চাপ আর মৌসুমী বায়ুর অবস্থানের দোহাই দিতে দিতে আবহাওয়া অফিসগুলোও ক্লান্ত হয়ে পড়ে আজকাল। শীত আর আসে না। পৃথিবীর বদলে যাওয়া আবহাওয়া নিয়ে লেখা হয় প্রবন্ধ। মাঝখান থেকে শীত ফেরারী হয়ে ফেরে দূরের কোনো গ্রামে, কোনো অরণ্যের অকস্মাৎ সীমান্তে।

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো ফেরারী শীত নিয়ে ‘শীতের খোঁজে’।

সেবার চা গাছের সবুজ দিয়ে ঘেরা ছোট্ট মফস্বল শহরটা কিন্তু শীত খুঁজে দেয়নি আমাদের। পৌঁছে দেখা গেলো বৃষ্টি আর শীতের সম্ভাবনা দু‘জনেই হাত ধরাধরি করে উধাও। শহরের সরু সরু গলিতে, কোনো খোলা জানালায় অথবা খোলা ছাদে পাওয়া গেলো না সুপর্ণাকেও। তাই টি-বোর্ডের বাংলোর বারান্দায় রাতে মান্না দে আর অমিয় গরলই সম্বল। অনেক রাতে মান্না দে ক্লান্ত হয়ে থেমে গেলেন। নিঝুম বসে থাকতে থাকতে টের পাই, টুপ টাপ করে কী যেনো ঝরে পড়ছে! হিম? শীতের আগমন কালের রাতে পাতার শরীরে জমা হওয়া সামান্য অথবা মৃদু একটু তরলের পতনে চারপাশের ঝোপ-জঙ্গল সচকিত হয়ে উঠলো! নাকী কোনো সাপ? অলস শরীর মেলে, বুকে ভর দিয়ে পিছলে এগিয়ে চলেছে শীতনিদ্রার আয়োজনের দিকে? এখানেই কোথাও হয়তো মেঠো মাকড়সা জাল বুনতে শুরু করেছে। ওই বোনাটুকু ছাড়া তার তো আর কোনো কাজ নেই। একদিন ভোরবেলা শিশির জমে ওই জালটুকু ছিঁড়ে গেলে, এ জন্মের কীর্তিশেষে শীতঘুমে যাবে সে-ও। পাশে বসে ছিলো কেউ। খসখস শব্দে দেশলাই থেকে কাঠি খুঁজে সিগারেট ধরায়। প্রথম কাঠিটা অসফল হলো। সামান্য ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেলো শীতের খোঁজে আসা কয়েকজন মানুষকে?

সামনের চেয়ারে ভূতগ্রস্থ হয়ে বসে থাক এক সঙ্গী বলে উঠেছিলো,

সিগারেটটা রেখে দে, এই ঠাণ্ডা হাওয়ার শরীরে কেমন একটা ঘ্রাণ আছে। পেতে দে তো।

হাওয়ার শরীরে কীসের ঘ্রাণ, শীতের?

কোনদিক থেকে আসছে হাওয়া?

ওদিকে কি সুপর্ণাদের বাড়ি?

মাথা ঠোকাঠুকি করে প্রশ্নগুলো।বাইরে আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে গেছে ছোট্ট শহরটা। শহরের পরে গ্রামগুলোও। ভাবি, এখানে শীত আসবে তো? অতি বয়স্য যারা, যাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অনেক অনেক পুরনো কঠিন শীত-তারা যত্ন করে ওষুধের শিশি বোতল গুছিয়ে রাখবে? ডাক্তারের দোকানে গিয়ে নানান প্রশ্নে ঝালাপালা করবে ডাক্তারের কান? আমরা শীতের কথা ভাবি। শীত খুঁজতে এসে মফস্বলে চোখ বন্ধ করে দেখি, কবেকার পুরনো ভোরে শিশির ঝরছে বড় বড় ফোঁটায়, মাঠ থেকে মাঠে  শক্ত হয়ে বসে থাকা কুয়াশা, একলা দাঁড়িয়ে থাকা খেজুর গাছের গায়ে বাঁধা মাটির কলসি। স্মৃতিগুলো শীত খুঁজতে আসা কয়েকটা মানুষকে জাগিয়ে রাখে রাতভর। যন্ত্রণা দেয়। কিন্তু শীতের খোঁজ মেলে না। শেয়ালের ডাক ভেসে আসে দূর থেকে। কোথায় কোন গ্রামের জীবনে শীত নামে আমার মনের মধ্যে। সেখানে তাঁতী পাড়ায় তাঁত চলে অবিশ্রান্ত, ঘরের ভিতরে হ্যারিকেনের চোখেও শীতের ঘুম।

চলচ্চিত্র নির্মাতা তারকোভস্কির কামেরায় ধূসর শীতের ছবি তোলা আছে। সারি সারি পপলার অথবা বার্চ গাছের সারি। তুষার পড়ে এক হাঁটু। পশ্চিমের সেই শীতের বিবর্ণ আর একরোখা ছবি মনের পর্দায় ভেসে আসে। তেমন শীতের রাগি চেহারা ভাগ্যিস আমাদের এই দেশে নেই। হয়তো পরিচিত দৃশ্য দেখতে দেখতে অভ্যস্ত চোখ সেই আলতো শীতের ছবিটাই দেখতে চায়। ছাদে বা বাগানের বেড়ায় লেপ বা কাঁথার রোদ পোহানো দেখেই আমাদে ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করে। রোদে শরীর মেলে দেয়া লেপ-কাঁথার দিন কবে ফিরবে কে জানে!

আধো আচ্ছন্নতায় বাংলোর বারান্দায় ফিরে আসি। ঠাণ্ডা মেঝে, ফুরিয়ে যাওয়া খাবারের প্লেট দাঁত বের করে হেসে বলে-

পেলে না তো শীতের দেখা? শীতকাল এবারও দেরি করে আসবে। বায়ুমণ্ডলে গভীর গোলমাল ঘটেছে।আকাশে পাল্টে গেছে কত কী! ঠিক মতো শীত না-পড়লে একদিন স্মৃতির মধ্যে কতকাল আগে দেখা দৃশ্যগুলোও অচেনা হয়ে যাবে।

ভয় পেয়ে যাই।শীতকালের খোঁজ যদি শেষে সুপর্ণাও বলতে না-পারে! আমিও যদি আর চিনতে না পারি সুপর্ণার বাড়ি। তখন কার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করবো-শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা?

তথ্যসূত্র: হৃদয়পুর, অবনঠাকুর

ছবিঃ সালমান শিদ্দিক প্রত্যয় ও গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199