শুভ জন্মদিন সিনেমাওয়ালা

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 14 May 2019

1025 বার পড়া হয়েছে

Shoes
লুৎফুল কবির রনি

আমাদের ফরিদপুরে জন্ম ও বাল্য-কৈশোর কাটানো, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়া মৃণাল সেন গেলেন ১৯৪০-এর দশকের সেই ঘটনাবহুল কলকাতায়। ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’র চরিত্রটি বলেছিল, ‘এ প্রজন্ম দাঙ্গা দেখেনি, দুর্ভিক্ষ দেখেনি, দেশভাগ দেখেনি।’ কিন্তু মৃণাল সেন এ সবই দেখেছিলেন। প্রতিবাদী হয়েছেন তখন থেকেই। যোগ দিয়েছেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএতে। সহকর্মী হিসেবে পেয়েছেন সলিল চৌধুরী, তাপস সেন, কলিম শরাফী এবং অবশ্যই ঋত্বিক কুমার ঘটককে।

শাবানা আজমী ও মৃনাল সেন

মৃণাল সেন তাঁর প্রথম দিককার ছবিগুলোর—‘রাতভোর’, ‘নীল আকাশের নিচে’—ব্যাপারে পরবর্তী জীবনে তেমন আগ্রহীও ছিলেন না। সহজ কারণ হচ্ছে, মৃণাল সেন নিজেকে তখনো যেন ঠিক খুঁজে পাননি। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য ছবি সে অর্থে ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০), যে ছবিতে দুর্ভিক্ষের উল্লেখ ছিলো। বাংলার দুর্ভিক্ষের বিষয়টি তাঁর আরও দুটি ছবি ‘কলকাতা ৭১’ ও ‘আকালের সন্ধানে’তে তিনি খুব বড়ভাবেই তুলে ধরেছেন।

পরাধীন ভারতে জন্মেছিলেন মৃণাল সেন, ১৯২৩-এর ১৪ মে। মাথার ওপর ছিলো প্রায় দেড়শো বছরের ঔপনিবেশিকতার চাপ। জন্ম থেকে জীবনের প্রথম দিকটা কাটে ফরিদপুরের ছোট মফস্ব্ল শহরে, যা আজ বাংলাদেশের অন্তর্গত। স্বাধীনতা অর্জনের পর বহু বছর ধরেই সিনেমায় আধুনিকতার নিরিখ কী, এক নাগাড়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন তিনি।

শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’ (২০০২)। প্রথম ছবি করেছিলেন ১৯৫৫-য়, ‘রাতভোর’। ‘পথের পাঁচালী’-র তুমুল সাফল্যের পাশে ‘রাতভোর’-এর ব্যর্থতা তাঁকে দমিয়ে দিতে পারেনি এতটুকু। পরবর্তী ‘নীল আকাশের নীচে’ ছুঁয়ে তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ থেকেই খুঁজে নিয়েছেন নিজের জমি। ফিল্ম, এই আর্ট ফর্মটির প্রতি তীব্র আসক্তি বা ভালবাসা না থাকলে বোধহয় এমন ক্রমোন্নতি অসম্ভব।

সত্যজিৎ রায়ের মতো গোড়া থেকেই ধ্রুপদী সাহিত্য বা সাহিত্যিককে নিজের ফিল্মের আশ্রয় করে তোলেননি তিনি। বরং সত্যজিতের সৃজন-ভাবনার বিপরীত বিন্দু থেকেই তাঁর ছবি করা শুরু। সত্যজিৎও স্বীকার করেছেন সে কথা। ‘দে স্টার্টেড অ্যাট অ্যাবাউট দ্য সেম টাইম অ্যাজ আই ডিড, ঋত্বিক অ্যান্ড মৃণাল।’ ‘দে ওয়্যার মেকিং ফিল্ম ভেরি ডিফারেন্ট ফ্রম মাইন, ভেরি ডিফারেন্ট, বাট ভেরি পাওয়ারফুল, আই থিংক।’

মৃণাল সেন বিশ্বাস করতেন কোনও ছবি-করিয়ের ‘সবচেয়ে বড় সঙ্কট হল আদর্শগত’। তার মোকাবিলা করতে পরিচালক হিসেবে সব সময় তিনি দায়বদ্ধ থাকতেন ছবির মূল বিষয়বস্তুর প্রতি, ফিল্ম মাধ্যমটির প্রতি এবং যে সময়ে তিনি ছবি করছেন, সেই সময়ের প্রতি। ফলে ষাটের দশকের মাঝামাঝি বা শেষ থেকে সারা সত্তর দশকের উত্তাল কলকাতা কিংবা তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা অনবরত উঠে আসতো তাঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর পর প্রায় প্রতি ছবিতেই।

স্মিতা পাতিল ও মৃনাল সেন

‘আকাশকুসুম’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ‘কোরাস’-এর মতো সাদাকালো ছবিতে বাঙালি মধ্যবিত্তের অসার স্বপ্ন বা স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি বুনে দিতেন তিনি। বাঙালি মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্বে আকীর্ণ, রুক্ষ, স্ববিরোধী আর অসুন্দর জীবন যেমন ঠাঁই পেত তাঁর ছবিতে, তেমনই নকশাল আন্দোলন থেকে জরুরি অবস্থা অবধি বামপন্থী আন্দোলনের শক্তি ও দুর্বলতার ইতিহাসও ধরা পড়তো তাঁর এই সব ছবিতে। ধরা পড়তো অসম্ভব দারিদ্র আর ভয়ঙ্কর শোষণ। পুলিশ-প্রশাসন-সরকারের সশস্ত্র সন্ত্রাস। গণতন্ত্রের বকলমে রাষ্ট্র বা আইন-আদালতে শাসন নিয়ে প্রায়ই স্বপ্রশ্ন হয়ে উঠতেন তিনি, সেই সময়কার প্রায় প্রতিটি ছবিতেই। সে দিক থেকে দেখলে মৃণাল সেনকে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না।

এই রাজনৈতিক সচেতনতার পিছনে ছিলো তাঁর ফরিদপুরের জীবন। বাবা ছিলেন পেশায় উকিল, চরমপন্থী কংগ্রেসি, বিপিনচন্দ্র পালের ঘনিষ্ঠ। মৃণাল সেনের জন্ম যে বছর, সেই ১৯২৩-এর রায়ত সম্মেলনের বক্তৃতায় বাবা ১৯১৭-র বলশেভিক বিপ্লবের সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেছিলেন। বড় হয়ে জানতে পেরে সে-কথা আজীবন স্মৃতিধার্য করে রেখেছিলেন মৃণাল সেন। বিপ্লবীদের ফাঁসির হুকুম হলে বাবা তাঁদের হয়ে কেস লড়তেন। এক বার গাঁধীজিকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সারা দেশে হরতাল। বাবা আদালতে তো গেলেনই না, জেলাশাসক কৈফিয়ত চাইলে স্পষ্ট বলে দিলেন কারণটা। সে জন্যে শাস্তি পেতে হয়েছিল তাঁকে। এ সব দেখতে দেখতেই বড় হয়েছেন মৃণাল সেন।

দেখেছেন, সুভাষচন্দ্র বসু আর বিপিনচন্দ্র পালের কী রকম স্নেহধন্য ছিলেন তাঁর মা। ব্রিটিশ-বিরোধী জনসভায় উদ্বোধনী গান গাইতেন মা। এ সব অভিজ্ঞতার কথা বহু বার বলেছেন তিনি: ‘তখন দেখেছি কত অসংখ্য লোক আসতেন আমাদের বাড়িতে। আসতেন সে-সব লোক, যাঁরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, যাঁদের পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে।... ফলে আমাদের বাড়িতে ক্ষণে ক্ষণে পুলিশের তল্লাশি চলতে লাগলো। কী করে মানুষ পালিয়ে বেড়ায় এটা আমি খুব ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি। মানুষ ভয় পেয়ে পালায়, এক জন মানুষ অনেক মানুষের জন্যেই পালায়। ছোটবেলা থেকেই আমি পুলিশ চিনেছি।’

নিজের নানান ছবিতে এই সব স্মৃতিকে পুনর্নির্মাণ করেছেন মৃণাল সেন। ধরাবাঁধা ছাঁচে আঁটা জীবনের গল্প বলতে চাননি বলেই বোধহয় কখনও ‘ট্র্যাডিশনালিস্ট’ হননি। নতুন কথা কিংবা নতুন বিষয় বিধৃত করার জন্যেই ফিল্মের ফর্ম বা টেকনিক নিয়ে অবিরত ভাঙচুর চালিয়ে গিয়েছেন। তাই কেতাবি কায়দায় ক্যামেরা চালানোটা কখনওই তাঁর ফিল্মের ধরন হয়ে ওঠেনি। অনেক সময় ক্যামেরার ফ্রেম স্লিপ করেছে। ফ্রেমলাইন ক্যামেরার মাঝখানে চলে এসেছে। পুলিশের লাঠি চালানো বা বিভিন্ন মারামারির শট তুলতে গিয়ে এটা ঘটেছে। পরে ওগুলোকে ও-ভাবেই রেখে দিয়েছেন। এ রকম উদাহরণ ছড়ানো আছে তাঁর ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ‘ইন্টারভিউ’-তে। এ ভাবেই তিনি চিত্রায়িত করতেন অসুন্দরকে। জীবনের মসৃণতার অভাব দেখানোর জন্যে সৃষ্টি করতেন টেকনিক্যাল জৌলুসের অভাব। খুব ভাল ভাবে মাধ্যমটাকে জানলে তবেই এটা করা সম্ভব।

ফর্মের এই ভাঙচুর নিয়ে মৃণাল সেনকে ঘিরে আলোচনা হয়েছে বিস্তর, তর্কাতর্কিও কম নয়। যেমন ‘ভুবন সোম’। ১৯৬৯-এ তৈরি এ শুধু মৃণাল সেনেরই প্রথম হিন্দি ছবি নয়, হিন্দি ছবির জগতেও প্রথম তরঙ্গ; আরও স্পষ্ট ভাবে বললে ‘নবতরঙ্গ’। ‘ভুবন সোম’ হিন্দি ছবির ভাবনার জগৎটাকে কিংবা বানানোর রীতিকে উল্টেপাল্টে দিয়েছিলো একেবারে। বাণিজ্যিক সিনেমার লোকজন বরাবর বলে এসেছেন, ফিল্ম আদতে খুব ব্যয়বহুল মাধ্যম, মৃণাল সেনের কাছে সেটাই ছিলো চ্যালেঞ্জ, কত কম খরচে, কত ভাল ছবি করা যায়। সেটাই করে দেখালেন ‘ভুবন সোম’-এ। মাত্র দেড় ঘণ্টার এই ছবিটি সরকারি ফিল্ম সংস্থা এফএফসি (আজকের এনএফডিসি)-র ইতিহাস বদলে দিয়েছিলো। ছবির তুমুল জনপ্রিয়তা সাহস জুগিয়েছিলো সংস্থাটিকে, পরে নতুন ধারার ছবিতে অর্থ বিনিয়োগের।

আশি থেকে নব্বইয়ের গোড়া পর্যন্ত যে ধরনের ছবি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন মৃণাল সেন, সেখানে মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবন যেন আরও বেআব্রু। আত্মরক্ষার আর কোনও অস্ত্র রইল না, প্রায় প্রতিটি ছবির চরিত্রদের তিনি চুল ধরে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন আয়নার সামনে। ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘খারিজ’, ‘খণ্ডহর’, ‘জেনেসিস’ বা ‘মহাপৃথিবী’ এ ধরনের ছবিতে আত্মসমালোচনা আর নিজেকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন তিনি। কতটা বাস্তবনিষ্ঠ হতে পারছেন বা হওয়ার চেষ্টা করছেন শিল্পকর্মীরা, কিংবা বাস্তবের ধাপ বেয়ে চলতে চলতে কোনও ইচ্ছাপূরণের মোহে আটকে পড়ছেন না তো তাঁরা, এ সব প্রশ্নেরই যেন উত্তর পাওয়ার একটা দুর্মর চেষ্টা ছবিগুলিতে।

‘মহাপৃথিবী’-র পর নিয়মিত ছবি করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ দশ বছরের ব্যবধানে যে-দু’টি ছবি করেছিলেন ‘অন্তরীণ’ আর ‘আমার ভুবন’, সে-দু’টি শিল্পমানের দিক থেকে গুরুত্বের। যখন নানা ভারতীয় ভাষায় অন্তত গোটা আটেক ছবি করেছেন, ওড়িয়া-য় ‘মাটির মনিষ’, তেলুগুতে ‘ওকা উরি কথা’ কিংবা হিন্দিতে ‘ভুবন সোম’, ‘এক আধুরি কহানি’, ‘মৃগয়া’, ‘খণ্ডহর’, ‘জেনেসিস’, ‘একদিন অচানক’, তখন অবিরত ভারতীয়তা বা আন্তর্জাতিকতার কথা বলে গিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন যে, আপনি কেন এত বিভিন্ন ভাষায় ছবি করেন? আমি বলি, আমি দারিদ্র নিয়ে ছবি করি। আফ্রিকাতে গিয়ে সোয়াহিলি ভাষায় ছবি করতেও আমার কোনও অসুবিধে হবে না, যদি আমি ফিজিক্যাল পিকিউলিয়ারিটিগুলো ধরতে পারি, যেটা সব সময় সারফেস-এ থাকে।’

একদিন প্রতিদিন’ হচ্ছে ‘ভুবন সোম’-য়ের মতোই মৃণাল সেনের আরেকবার মোড় ফেরা। ফিরে এলেন তিনি বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে। বরং বলা চলে বাঙালি মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের সংকটের কাছে। বাড়ির তরুণী মেয়েটি রাতে বাড়ি ফিরে এল না। টান টান চিত্রনাট্য, গীতা সেন-শ্রীলা মজুমদারের দৃষ্টিকাড়া অভিনয় ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মানব-অনুভূতিগুলো তুলে ধরে মৃণাল সেন আমাদের মধ্যবিত্ত অস্তিত্বের পাশেই যে মুখ ব্যাদান করা এক বিশাল অন্ধকার খাদ রয়েছে, তার মুখোমুখি করলেন। মেয়েটি সারা রাত বাড়ি ফেরেনি। কোথায় ছিল সে? মৃণাল সেন বলেননি। কেবল আমাদের মধ্যবিত্তদের সম্মানের নিরাপত্তার প্রতি এক বিরাট প্রশ্ন ছুড়ে মেরেছেন। বিষয়টি আরও সূক্ষ্মতায় ফুটেছে ‘খারিজ’-এ। অর্থনীতির নোংরা সুতাগুলোর আড়ালে মধ্যবিত্তের দ্বিচারিতা যেন আরও নগ্নভাবে তুলে ধরলেন মৃণাল সেন। বরং যে মর্যাদাবোধ নিয়ে মৃত কাজের ছেলেটির গ্রাম থেকে আসা বাবা বিদায় নিলো, তা যেন মধ্যবিত্তের সব ঠুনকো মর্যাদাবোধকেই এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত করে গেলো। লন্ডনের গার্ডিয়ান লেকচারে সত্যজিৎ রায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘মৃণাল সেন হিটস সেফ টার্গেটস।’ বাঙালি মধ্যবিত্তদের নিয়ে মৃণাল সেন কিন্তু এসব ছবিতে খুব সফলভাবেই তাঁর টার্গেটগুলোর বিবেককে চাবুক মারতে সক্ষম হয়েছেন।

কোনো কোনো ছবিতে মধ্যবিত্ত অস্তিত্বের আরও গভীরে চলে যান মৃণাল সেন, প্রায় আস্তিত্বিক স্তরে। ‘একদিন আচানক’-এ নিরুদ্দেশ হওয়া অধ্যাপকের মেয়েটি ওই যে বলেছিল, ‘বাবা বুঝতে পেরেছিল বাবা খুব সাধারণ। আর সাধারণ হিসেবে সারা জীবন কাটানো খুব কষ্টকর। বাবা আর ফিরবে না।’ মৃণাল সেন যেন বারবারই মধ্যবিত্তকে তাদের লোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও উচ্চম্মন্যতার ঠুনকোপনা সম্পর্কে সচেতন করতে চাইছেন, এসব ছেড়ে তাদের সমাজ বদলানোর বিষয়ে সচেতন করতে চাইছেন, লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চাইছেন।

ঠিক প্রত্যক্ষ রাজনীতি নয়, মহাকালই যেন ছবির বিষয়, মৃণাল সেনের শেষের দিককার ওই ছবিটি ‘মহাপৃথিবী’। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ছে, বদলে যাচ্ছে পূর্ব ইউরোপ। বাড়ির ছেলেটি নকশাল আন্দোলনে মৃত। ছেলেটি, ছেলেটির মা, পরিবারটি, গোটা এক প্রজন্মই তো বিশ্বাস করেছিল সমাজতন্ত্রে, আত্মহত্যার ডায়েরিতে মায়ের অভিমান, ‘বুলু, তোরা কি সব মিথ্যে হয়ে যাবি?’ এ তো শুধু এক মায়ের প্রশ্ন নয়, শোষণহীন এক সমাজের স্বপ্ন দেখা কয়েক প্রজন্মেরই জিজ্ঞাসা ও অভিমান।

‘র‌্যাডিক্যাল’, ‘মার্ক্সবাদী’, ‘ডকট্রিনের’ এ রকম নানা বিশেষণই মৃণাল সেন পেয়েছেন তাঁর জীবদ্দশায়। সেসব হয়তো আংশিক সত্যও। তবে সবার ওপরে মৃণাল সেন একজন সৃজনশীল শিল্পী, একজন রাগী শিল্পী, যিনি দর্শকদের দিকে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ছুড়ে দিতে ভালোবাসেন—‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘খারিজ’। আর সচেষ্ট থাকেন দর্শকের আত্মসন্তুষ্টিকে ভেঙে দিয়ে তাদের মানবিক বিবেকবোধকে জাগ্রত করতে। মৃণাল সেনকে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাই সব সময়ই স্মরণ করা হবে। স্মরণ করা হবে সিনেমাশিল্প মাধ্যমটির ওপর সুদক্ষ দখলের একজন নির্মাতা হিসেবে, যিনি সিনেমার আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন আমাদের বিবেক ও সমাজের কাছে সদাই কিছু তির্যক মন্তব্য ছুড়ে দিতে।

আর আমাদের দুই পারের বাঙালিদের কাছেই মৃণাল সেন এমন একজন প্রিয় শিল্পী হিসেবে বয়ে যাবেন, যিনি যত দিন খেলেছেন উইকেটের চারিধারে পিটিয়ে খেলেছেন, সব ধরনের শট খেলতে জানতেন। দুঃখজনকভাবে নব্বইয়ের ঘরে তিনি আটকে গেলেন। শতায়ু হতে পারলেন না। এ আক্ষেপ তো আমাদের আজীবন রয়েই যাবে!

টেলিফিল্ম, শর্টফিল্ম এবং ডকুমেন্টারি বাদ দিলে তাঁর পূর্ণদৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্মের সংখ্যা সাতাশ। বিদেশে, বিশেষ করে রাশিয়া ও ফ্রান্সে যেমন সম্মানিত, তেমনই রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন, পেয়েছেন পদ্মভূষণ, অর্জন করেছেন ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ উপাধি ‘দাদাসাহেব ফালকে’।

বাংলা চলচ্চিত্রের ‘ভুবন সোম’ তিনি। তার নির্মাণের ‘মৃগয়া’য় চড়ে বিশ্ব দরবারে বাংলা চলচ্চিত্র মর্যাদার আসন নিয়েছে। বাড়ির উঠান থেকে ময়দান, কানাগলি থেকে রাজপথ, বস্তি থেকে অট্টালিকা তার সিনেমায় এমন ভাবে উঠে এসেছে যা শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট ভূখন্ডে আটকে না থেকে বৈশ্বিক রূপ ধারণ করেছে। আর এখানেই তার অনন্যতা।

২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও ৪টি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ৬টি চলচ্চিত্র বিষয়ক মৌলিক গ্রন্থও লিখেছেন।

চলচ্চিত্রের ‘নীল আকাশের নীচে’ ‘রাতভোর’ জেগে থাকা সারথী মৃণাল সেন আজ ধরণীতে আগমনী দিন।

শুভ জন্মদিন সিনেমাওয়ালা।

ছবি: গুগল

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199