“সতীশ যে স্বীকার করেছে তার কাপড় বাসি, এটা অবিশ্যি প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু বাসি কাপড়ে কিছু ছোঁয়া যে খারাপ কাজ, এ বিশ্বাস যার নেই, তাকেই বা দোষ দেওয়া যায় কী করে, এ আমি বুঝতে পারিনে। সতীশের ভেবে দেখবার ক্ষমতা ও বুদ্ধির চেয়ে যদি কারুর বুদ্ধি ও বুঝবার শক্তি বেশি থাকে, তার জন্যে তাকে কি নরকে পচে মরতে হবে?
-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (দৃষ্টিপ্রদীপ)
বনগাঁ হাই ইংলিশ স্কুল থেকে পাশ করে বিভূতি গেল মায়ের কাছে। সে কলকাতায় পড়তে চায়। মা মৃণালিনী নিষেধ করে বলে বসলেন, ‘গরিবের ঘরে এর চেয়ে বেশি পড়াশুনো হয় না খোকা। তুই চাকরি খুঁজে নে!’
মায়ের কথা শোনেনি বিভু।
ম্যাট্রিকের প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করে সে ভর্তি হল কলকাতার রিপন কলেজে। ঠাঁই হলো, হিন্দু হস্টেলের কাছে ২৪/১ মদনমোহন সেন লেনের মেসবাড়ি।
কিন্তু টাকা দেবে কে?
মনে আছে, যেদিন বনগাঁর স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিলো, মা লক্ষ্মীর ঝাঁপি ভেঙে পয়সা দিয়েছিলেন। শেষ সম্বল মহানন্দর সিঁদুর পরানো টাকাটাও বিক্রির জন্য তুলে দিয়েছিলেন ছেলের হাতে!
আর আজ? এই কলেজবেলায়? সেই মা-র আশ্রয় এখন মামাবাড়ি। মুরাতিপুরে।
কলেজে মাইনে বাকি। মেসে বাকি। বন্ধুদের কাছে বাকি! মেসে খেতে বসলেই ম্যানেজার তাগাদা দেয়। গলা দিয়ে যেন ভাত নামে না বিভূতির।
একদিন দুপুরবেলা। রুমমেটের পরামর্শে দু’জনে জানলা গলে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল! মহল্লা জুড়ে চিৎকার, ‘চোর, চোর’! চুরির অপবাদে অপমানে নুয়ে পড়লো বিভু।
এই দুঃখ, দহিত জীবন নিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম বিভাগে পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হলো। আবার সেই এক চিন্তা! অর্থের জোগান।
এ বার সহায় হলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। আশার আলো দেখলেন মহানন্দ-সন্তান।
বিভূতিভূষণের নতুন ঠিকানাও হলো, ৮/১ স্বর্ণময়ী রোড। এও এক মেসবাড়ি।
বইটি তখনো লেখা হয়নি। ছাপা হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। অথচ ‘চঞ্চলা’ ১ টাকা সিরিজের প্রথম উপন্যাস। লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বইটি প্রকাশ না হতেই প্রচারে চলে এলো। ছায়াসঙ্গী পাঁচু গোপাল, শোকাতুর দাদাকে (বিভূতি) মা মৃত্যুর পর দুঃখ অনুভূত থেকে লেখায় ফেরাতে, তাকে লেখক মনস্ক করতে এ উপন্যাস প্রকাশের আগেই প্রচার ঘটিয়েছিলেন ঠিক এভাবেই। তাই অনেকটা নিরুপায় হয়ে বিভূতি এ উপন্যাস লেখতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই বলেন, ‘সেই পল্লী গ্রামের একটি ছায়াবহুল নিভৃত পথ দিয়ে শরতের পরিপূর্ণ আলো ও অজস্র বিহঙ্গ কাকলীর মধ্যে প্রতিদিন স্কুলে যাই, আর একটি গ্রাম্য বধূকে দেখি পথিপার্শ্বের একটি পুকুর থেকে কলসী কক্ষে প্রতিদিন স্নান করে ফেরেন।’ বই সম্পর্কে কৌতূহলের কারণে এটি নিয়ে লেখকেরও উপাদান সংগ্রহের আগ্রহ দানা বেঁধে উঠল। আর বইয়ের এ উপাদানে নায়িকা হিসেবে আবির্ভূত হলেন সেই গ্রাম্য বধূটি এবং নায়ক হলেন লেখক নিজেই।
লেখাটি যদিও ১৩২৮ বাংলা মাঘ সংখ্যা বা ১৪.০১.১৯২২ সালে, তবে প্রবাসী পত্রিকায় নায়িকা বদলে উপন্যাসের নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘উপেক্ষিতা’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা যেখানে ছাপা হয়, সেখানে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ছাপা হয়েছে। এ আনন্দে পাঠকের সঙ্গে লেখক এবং পাঁচু গোপাল যেন হয়ে গেলেন আত্মবিহ্বল এক আত্মহারা মানুষ।
সময়টা বিশ শতকের তিনের দশক।বাংলা সাহিত্যের মধ্যগগনে বিরাজ করছেন রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র।তাঁদের সৃষ্টিতে পাঠককূল মুগ্ধ।সংগে সংগে প্রচলিত ভাবনার বিপরীতে, এক পাল্টা হাওয়া প্রবাহ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে হাজির হলেন কল্লোল গোষ্ঠির লেখককুল।পাঠক হলো তাতে চমকিত,বিস্মিত আর ঠিক এইসময়ে এই দুই ভাবনা, নীতির বাইরে গিয়ে সম্পুর্ন নিজস্ব ভঙ্গিতে মানুষ, প্রকৃতি আর ঈশ্বর ভাবনার সম্মিলিত রূপকে সহজ,সরলভাবে তুলে ধরে সাহিত্যকাশে আবির্ভূত হলেন বিভূতিভূষন বন্দোপাধ্যায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার কৈশোরের প্রথম শিহরণ। তাঁর অরণ্যভ্রমণের বর্ণনাগুলো পড়ে মন ছুটে যেত প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে। ছোট ক্লাসে প্রথম যেদিন আরণ্যক নামটা পড়েছিলাম, মনের গভীর গোপন প্রদেশে অরণ্যচারী এক সন্নাসীর জন্ম হয়েছিল। কল্পনায় আমি অনেকবার গহীন অরণ্যের ভেতর হেঁটে বেড়িয়েছি। পায়ের নিচে মরা বাঁশপাতা চুর চুর হয়ে যাওয়ার শব্দে চমকে উঠেছি। স্বপ্নে ঝর্ণার শীতল জলের স্পর্শে গভীর রাতে ঘুম ভেঙেছে অনেকবার।
কলকাতা ছেড়ে সেবার বেশ কিছু দিন ব্যারাকপুরে রয়েছেন বিভূতিভূষণ। বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই।
ইতিমধ্যে ‘অপরাজিত’-র প্রথম খণ্ড বেরিয়েছে। দেখা হয়ে গেল কিশোরী খুকুর সঙ্গে। খুকু স্কুলবেলার গণিতের শিক্ষক যুগলমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে।
দিন নেই, দুপুর নেই দুটিতে মশগুল পড়া পড়া খেলায়। খুকুর চুল, জামার গন্ধে ভুর ভুর বিভূতির বিকেল।
কত প্রশ্ন খুকুর! বিভূতি রাগে না। বার বার পড়া-লেখায় ভুল করে খুকু। বিভূতির ক্লান্তি নেই, শুধরে দেন। হাত ধরাধরি করে কুঠির মাঠে গিয়ে দাঁড়ায় দু’জন। না দেখে থাকতে পেরে এক জন ছাদে, তো অন্য জন পাশের মাঠে। গোল হলুদ থালার মতো চাঁদের রাতে ইছামতীর জল কেটে কেটে ডুবসাঁতার! বিভূতিকে লেখা সুপ্রভার চিঠি দেখে খুকুর রাগ হয়! রাগ ভাঙাতে উপহার দিলেন ‘চাঁদের পাহাড়’।
খুকু কলকাতা দেখতে চায়। নিয়ে এলেন বিভূতি। উঠলেন নীরদ-অমিয়ার কাছেই। দু’দিন কলকাতার হাওয়ায় খুব উড়লেন দুটিতে!
তেতে উঠল ব্যারাকপুর। সরগরম গালগল্প, রঙ্গব্যঙ্গ বিভূতি-খুকুকে নিয়ে!
অন্যত্র খুকুর বিয়ে ঠিক করলেন যুগলমোহন। আর খুকুকে লুকিয়ে সে-বিয়ের টাকার জোগান দিলেন বিভূতি।
কলকাতায় এসেছেন।
কলেজ স্ট্রিটে এক প্রকাশনা দফতরে বসে আড্ডা দিচ্ছেন।
আড্ডায় তাঁর সমসাময়িক অনেক সাহিত্যিকও আছেন। এমন সময় উত্তরবঙ্গ থেকে দু’জন এলেন হন্তদন্ত হয়ে। তাঁরা জনৈক সাহিত্যিককে ধরলেন।
উত্তরবঙ্গে সাহিত্যসভায় তাঁরা সেই সাহিত্যিককে নিয়ে যেতে চান। সেই খ্যাতনামা সাহিত্যিককে তাঁদের সভায় সভাপতিত্ব করতে হবে। কিন্তু লেখকমশাই যাওয়ার জন্য নানারকম শর্ত আরোপ করেই চলেছেন।
শুনে ছেলে দু’টির কাঁচুমাচু দশা।
তাঁরা বারবার বলছেন, তিনি না গেলে তাঁদের সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। সে কথা বিবেচনা করেও যদি একটি বারের জন্য তিনি যান।
কিন্তু সাহিত্যিক তাঁর শর্তে অনড়। শেষে ছেলে দুটি নিরুপায় হয়ে ফিরতে যাবেন, হঠাৎ পিছন থেকে বিভূতিভূষণ তাঁদের ডাক পাড়লেন। বললেন, তিনি গেলে কি তাদের কাজ হবে? একটা দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট হলেই চলবে।
ওঁদের কাছে বিভূতিভূষণের চেহারাটি একেবারে অচেনা। তাই প্রস্তাব শুনে অতি সাধারণ পোশাক পরা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে তাঁদের থতমত অবস্থা।
ইনি আবার কে?
তাঁদের কিন্তু-কিন্তু ভাব দেখে বিভূতিভূষণ বললেন, ‘‘আমার একটা বই আছে। হয়তো শুনে থাকবে, ‘পথের পাঁচালী’।’’
শুনে ছেলে দুটির চোখ বিস্ফারিত। তাঁরা বললেন, ‘‘আপনি বিভূতিভূষণ!’’
ওঁকে প্রণাম করে আড়ালে গিয়ে তাঁরা বললেন, উনি রাজি না হয়ে ভালই হয়েছে। আপনাকে পাওয়া গেল!
বিভূতিভূষণের এই বলার মধ্যে ছেলে দুটির প্রতি যেমন তাঁর মায়া ধরা পড়ে, তেমন কোথাও বোধ হয় ওঁর স্থান থেকে স্থানান্তরে উড়তে থাকা ডানাও ছায়া ফেলে যায়!
যায় না কি?
এমনকী তাঁর মৃত্যুকালের কথাতেও কেমন যেন প্রকৃতির গন্ধ হামাগুড়ি দেয়।
প্রান্তবেলায় ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘‘ভয় নেই, ব্যাঙ্কে টাকা জমিয়ো না।…পৃথিবীতে কোনও শান্ত, গ্রাম্য নদীর কূলের চিতায় তোমার হুঁশিয়ার জীবন যখন শেষ হয়ে যাবে, সেদিন থেকে এই অসীম,অনন্ত রহস্য তোমার সম্পত্তি হয়ে দাঁড়াবে।’’
এ বার্তা বোধহয় শুধু আরণ্যক-এরই মানায়!
শুভ জন্মদিন জঙ্গল-ঈশ্বর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশ্ব-চলচ্চিত্রের অন্যত্যম কিংবদন্তীর বিদায়
16 Sept 2022
1255 বার পড়া হয়েছে
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
7 Sept 2022
1260 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন চে গুয়েভারা
14 Jun 2022
1355 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন সত্যজিৎ রায়
2 May 2022
1215 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন আজম খান
28 Feb 2022
1165 বার পড়া হয়েছে
একজন সঞ্জীব চৌধুরী...
25 Dec 2021
2535 বার পড়া হয়েছে
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ও বেপথুর ষড়যন্ত্র
15 Aug 2021
1025 বার পড়া হয়েছে
ছুটি, প্রভু, ছুটি
22 Apr 2021
2185 বার পড়া হয়েছে
আপনাকে মনে পড়বে কবরী
17 Apr 2021
785 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন শচীন দেব বর্মন
1 Oct 2020
1330 বার পড়া হয়েছে
বিদায় সাইদা খানম
18 Aug 2020
1065 বার পড়া হয়েছে
আলী ভাই চলে যাননি...
13 Aug 2020
2075 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন ফিরোজা বেগম
28 Jul 2020
605 বার পড়া হয়েছে
ভালো থাকুন ফরীদি ভাই ...
29 May 2020
1865 বার পড়া হয়েছে
এখন সহস্র নক্ষত্রের ভীড়ে আপনিও একজন...
30 Apr 2020
2115 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন ঋত্বিক ঘটক
4 Nov 2019
980 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন জহির রায়হান
19 Aug 2019
1595 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন সিনেমাওয়ালা
14 May 2019
1030 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন সুচিত্রা সেন
6 Apr 2019
2235 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন সেলিনা পারভীন
31 Mar 2019
2210 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন বিসমিল্লাহ খাঁ
21 Mar 2019
775 বার পড়া হয়েছে
চলে গেলেন ফিরোজ মামা
18 Mar 2019
845 বার পড়া হয়েছে
সোনার বাংলা গেয়ে বিজয় দেখা হয়নি তাঁর
16 Feb 2019
1220 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
12 Sept 2018
1285 বার পড়া হয়েছে
স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।
সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।
Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]
Phone: +8801818189677, +8801717256199