আজ কৃষ্ণকায় ১৫ আগষ্ট – বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় দিন। ১৯৭৫ সালের এদিন ষড়যন্ত্রকারীরা সপরিবারে হত্যা করেছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এ নৃশংসতার কোন তুলনা নেই। মনে আছে, এ ঘটনার তিন দশক পরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে তৎকালীন মহাসচিব কোফি অ্যানন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমরা কি করে এ জঘন্যতম কাজটি করতে পারলে’? লজ্জায় আমি তাঁর মুখের দিকে তাকাতে পারি নি। উত্তর দেয়া তো দূরের কথা।
আমার সব সময়ে মনে হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট তো শুধু জাতির পিতাকেই হত্যা করা হয় নি, তাঁর চিন্তা-চেতনা আর মূল্যবোধ, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম সেগুলোকেও হত্যা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ষড়যন্ত্র শুরু হয় বাঙ্গালী জাতিকে পথভ্রান্ত করার, পরবর্তী প্রজন্মকে বেপথু করার। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের ঘটনা ‘একদল পথভ্রষ্ট সৈনিকের’ হঠকারী কোন কাজ ছিলো না, এটা ছিলো একটি শান্তমাথার দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রে ফল। সে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো বাংলাদেশের বিরোধীশক্তিগুলো, তাদের স্হানীয় দোসরেরা এবং বিদেশী সহযোগীরা।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের মাত্র ৪ বছর আগে তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে ন’মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি মূল্যবোধের।
সে চেতনা ও মূল্যবোধকে মাথায় রেখে বঙ্গবন্ধু চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন – জাতীয়তাবাদ, গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙ্গালী আত্মস্বত্ত্বার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মস্বত্ত্বার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গনতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিকা অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা, ও সর্বপ্রকার সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
এই আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর ওপরে ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম ও পথচলার শুরু। কিন্তু আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে ও তাঁর নিকটজনকে নৃশংসভাবে হত্যার পরে রাষ্ট্রযন্ত্র এ সব মূল্যবোধকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইতিহাসের বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে বেপথু করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
১৯৭৫এর পরে বাঙ্গালী জাতি এবং বাংলাদেশের মৌলিক চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধকে নস্যাৎ করার জন্যে তখনকার রাষ্ট্রযন্ত্র বিবিধ প্রক্রিয়া শুরু করে, যার নানান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক মাত্রিকতা ছিলো। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই রাষ্ট্রীয় অপ:শক্তি তাদের অপ:কর্মের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে।
১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেয়ার উদ্দেশ্যে পাঁচটি চিহ্নিত কাজ করা হয়। প্রথমত: সংবিধানকে ওলোট-পালোট করে তা থেকে মৌলিক চারনীতির বিচ্যুতি ঘটানো- যেমন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্দ্রকে বাদ দেয়া। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে পরিণত করার অপ:প্রয়াস চালানো হয়।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের বিরোধী মৌলবাদী শক্তিগুলোর পুনর্বাসন এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হয়।বাংলাদেশের যারা বিরোধিতা করে যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিলো, তারাই বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়ে গাড়ীতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নানান উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত করে বিদেশে নিরাপদে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
তৃতীয়ত: পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসকে বিকৃত করে তরুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে বেপথু করার অপ:প্রয়াস চালানো হয়। পাঠ্যসূচীকে ইসলামীকরণের জন্যে অন্য ধর্মের কবি-লেখকদের লেখা বাদ দেয়া হয়। বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয় – যেমন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে ঘোষণা করেন, আমরা বাঙ্গালী না বাংলাদেশী ইত্যাদি।
চতুর্থত: দেশের মধ্যে উদারপন্হী চিন্তা-চেতনাকে নস্যাৎ করা এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সব রকমের সংখ্যালঘু জোটের নিপীড়ণ সংহত করা হলো।রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের নাম করে আমাদের মূল্যবোধের ধর্মনিরপেক্ষতাকে নষ্ট করা হলো এবং সমাজের অসাম্প্রদায়িক কাঠামোকে আঘাত করা হলো।
পঞ্চমত: জোটনিরপেক্ষ চরিত্র ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। এর একটি উদ্দেশ্য ছিল সম্পদশালী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অর্থপ্রাপ্তি, অন্যদিকে এসব দেশগুলোর সঙ্গে একটি আদর্শগত সংযোগ স্হাপন।
এসব কর্মকান্ডের প্রেক্ষাপটে তিনটি প্রবণতা লক্ষ্যনীয়: এক, একসময়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পীঠস্থান থেকে বলা হয়েছিল, ‘অর্থ কোন সমস্যা নয়’। দৃশ্যমানতা। জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নষ্ট করার এর চেয়ে আর ভালো উপকরণ হয় না। দুই, ‘আমি রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্যে কঠিন করে তুলবো’। একটি সুস্হ রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করতে এরচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র নেই। তিন, দলবদলের রাজনীতিকে উৎসাহিত করা হয়েছিলো।এ সবেরই সমণ্বিত ফলাফল হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতিতে সুস্হ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে স্হায়ীভাবে পঙ্গু করে দেয়া।
এ সবকিছুর কারনে পরবর্তী সময়ে তিনটে ধারার সৃষ্টি হয়েছে স্বদেশে। এক, যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আদর্শিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনি এবং এর বিরোধিতা করেছে, তাদের অবস্হান আরো সংহত হয়েছে। দুই, আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, তাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ নামটি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শিক মূল্যবোধ দ্বারা সর্বদা সার্বক্ষনিকভাবে উদ্বেলিত হয়েছি, তেমনি আমাদের প্রজন্মের আরেকটি অংশ তো সবকিছু শুধু বিস্মৃতই হই নি, বেপথুও তো হয়েছি। তিন, জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে আমদের মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধ হয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে, নয় বিকৃত হয়ে উপস্হাপিত হয়েছে।
২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। আমরা একটি ক্রান্তিকালের মাঝখান দিয়ে চলেছি। ১৯৭১ সালের মতো আজও একটি সংগ্রাম আমাদের করতে হবে – সে লড়াই বাংলাদেশের মূল্যবোধকে সংহত করার, সে যুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চিন্তা-চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করার। চূড়ান্ত বিচারে, এ লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই – এ লড়াই জিততে হবে।
ছবিঃ গুগল
বিশ্ব-চলচ্চিত্রের অন্যত্যম কিংবদন্তীর বিদায়
16 Sept 2022
1260 বার পড়া হয়েছে
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
7 Sept 2022
1270 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন চে গুয়েভারা
14 Jun 2022
1365 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন সত্যজিৎ রায়
2 May 2022
1220 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন আজম খান
28 Feb 2022
1170 বার পড়া হয়েছে
একজন সঞ্জীব চৌধুরী...
25 Dec 2021
2560 বার পড়া হয়েছে
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ও বেপথুর ষড়যন্ত্র
15 Aug 2021
1030 বার পড়া হয়েছে
ছুটি, প্রভু, ছুটি
22 Apr 2021
2200 বার পড়া হয়েছে
আপনাকে মনে পড়বে কবরী
17 Apr 2021
790 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন শচীন দেব বর্মন
1 Oct 2020
1335 বার পড়া হয়েছে
বিদায় সাইদা খানম
18 Aug 2020
1075 বার পড়া হয়েছে
আলী ভাই চলে যাননি...
13 Aug 2020
2085 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন ফিরোজা বেগম
28 Jul 2020
610 বার পড়া হয়েছে
ভালো থাকুন ফরীদি ভাই ...
29 May 2020
1870 বার পড়া হয়েছে
এখন সহস্র নক্ষত্রের ভীড়ে আপনিও একজন...
30 Apr 2020
2120 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন ঋত্বিক ঘটক
4 Nov 2019
980 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন জহির রায়হান
19 Aug 2019
1605 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন সিনেমাওয়ালা
14 May 2019
1030 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন সুচিত্রা সেন
6 Apr 2019
2245 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন সেলিনা পারভীন
31 Mar 2019
2225 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন বিসমিল্লাহ খাঁ
21 Mar 2019
780 বার পড়া হয়েছে
চলে গেলেন ফিরোজ মামা
18 Mar 2019
855 বার পড়া হয়েছে
সোনার বাংলা গেয়ে বিজয় দেখা হয়নি তাঁর
16 Feb 2019
1230 বার পড়া হয়েছে
শুভ জন্মদিন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
12 Sept 2018
1300 বার পড়া হয়েছে
স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।
সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।
Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]
Phone: +8801818189677, +8801717256199