নিজস্ব সেই একলা স্টেশন আমার

কনকচাঁপা

কণ্ঠশিল্পী ও লেখক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 1 Dec 2022

2455 বার পড়া হয়েছে

Shoes

শিল্পী কনকচাঁপা এবার গানের পাশাপাশি প্রাণের বাংলার পাতায় নিয়মিত লিখছেন তার জীবনের কথা। কাটাঘুড়ির মতো কিছুটা আনমনা সেসব কথা, হয়তো কিছুটা অভিমানিও। কিছুটা রৌদ্রের মতো, খানিকটা উজ্জ্বল হাসির মতো।

স্টেশন অনেক কিছুর হয়।বাস স্টেশন, রিকশার কিছু নির্দিষ্ট স্থল,নৌকার ঘাট এবং রেল গাড়ির স্টেশন। স্টেশন ব্যাপারটাই আমার কাছে অন্য রকম দ্যোতনা সৃষ্টি করে হৃদয়ে। শিশুবয়সে সেগুলো ব্যক্ত করতে পারতাম না কিন্তু আমাকে রেলস্টেশন বা নদীর তীর ভয়াবহ কষ্ট দিতো।

দাদাবাড়ীতে বিধবা দাদীমা একাকী থাকতেন।আব্বা তাঁর একমাত্র সন্তান। তাই আমরা আমার দাদীমার সত্যিকারের নয়নমনি ছিলাম। আর দাদীমা ছিলেন আমাদের কলিজা। বছরে দু’বার স্কুলের ছুটিতে দাদীবাড়ি গিয়ে ফেরার পথে হৃদয় বিদারক অবস্থা তৈরি হতো। বড়দের বাক্য অনুকরণ করে দাদীমাকে জড়িয়ে ‘নিজের যত্ন নিও’ বলে কাঁদতাম কিন্তু আমি জানি আমি আরও কিছু বলতে চাইছি।সেগুলো ঠিক বলতে পারতাম না।দাদীমা আরও আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে নৌকার গলুই ধরে দাঁড়িয়ে ভালো করে পড়াশোনা করা, ভালো হয়ে থাকা এগুলো উপদেশ দিতেন খুব নীচুস্বরে, আর কাঁদতেন। আমরা হয়তো জোরেই কাঁদতাম। বিদায় নেয়া শেষই হতো না।মাঝি অনেক মায়া থাকা সত্বেও একসময় বিরক্ত হয়ে জোরে হাঁক ছাড়তেন। ‘নৌকা থিন সরে দাঁড়ান গো,নৌকা ছাড়া নাইগবে’ আহা! কি কষ্টকর বাক্য! নৌকা ছেড়ে দিলে একসময় দাদীমাসহ সবাই এক বিন্দুতে পরিনত হওয়া পর্যন্ত মনে হতো ঝাঁপ দিয়ে আবার ফিরে যাই! কিন্তু! বুঝতাম ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নাই! জীবন, বাস্তবতা বড়ই কঠিন।

 আর রেলস্টেশন! রেলস্টেশন আমার অবসেশন! রেললাইন, বগি, বাথরুমের পরিচিত দুর্গন্ধ, অপরিস্কার জামাকাপড় পরা মারকুটে কুলি,শিশুকুলির ময়লা মাখানো বাড়িয়ে দেয়া হাত, পত্রিকাওয়ালা, ঘরপালানো উস্কোখুস্কো বালক,বারবনিতা,রেলের পাতের স্ক্রু,মাঝখানের জোড়া! অপূর্ব ডিজাইনের কমলাপুর রেলস্টেশন! আমার অবচেতন মনে বিশাল জায়গা করে নিয়েছে। যখন আমরা গ্রামের বাড়ি যেতাম তখন আমরা একটু বেশি দিন থাকার জন্য আব্বাকে রেখে কাকা মামাদের সঙ্গে যেতাম।তখন শুধু মনে হতো বিদায় দিতে গিয়ে আব্বা যদি রেলগাড়ীর রেললাইনে পা আটকে ফেলেন! কি ভয়াবহ দুঃচিন্তা ছিলো শিশুমনে! সহজ ভাবে বললে বলা যায় একই সঙ্গে রেলগাড়িকে আমি ভালোবাসি এবং ভয় পাই।ছোট বেলায় একবার আমাদের চেংটুকাকা কোন এক স্টেশনে মেঝোবোন রত্না’পার আবদারে বড়ই কিনতে নামার পরে বড়ই বেছে বেছে কিনতে গিয়ে ট্রেন ছেড়ে দেয়।আমরা ছোটরা উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে দেখলাম কাকা চোখের সামনে একটা হাত বাড়িয়ে বড়ইয়ের ঠোঙা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছানোর চেষ্টায় হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে অপসৃয়মান হলেন।কি ভয়ংকর দৃশ্য! অথচ কিনা পরদিন কাকার বিয়ে।কি ভজঘট ব্যাপারই না হয়েছিল সেবার। আমরা কাকাকে ছাড়াই গায়ে হলুদের রঙ মাখামাখি করেছিলাম আর তার পরদিন বরযাত্রার বেঁধে দেয়া সময়ের অনেক পরে কাকা বাড়ি পৌঁছেছিলেন কারণ উনি ট্রেনে উঠতে না পারার পরের আরও দুইটা ট্রেন মিস করেছেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে!

সারাজীবনে পেশার জন্য অনেক বার সারাবাংলা অথবা দেশের বাইরেও রেলপথ এ এখানে ওখানে গিয়েছি।ট্রেন ছাড়ার সময় হলে আমার জীবনসঙ্গী হয়তো ধুমপানের জন্য নীচে নেমেছেন অথবা জানালা দিয়ে মাথা বের করেছেন অথবা একটু কমলা, পানি, বিস্কিট কিনতে নীচে নেমেছেন, সঙ্গে সঙ্গে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে।যদি ট্রেনে উনাকে ছাড়াই ছেড়ে দেয়! আমি একা! কোথায় নামবো! এই অদ্ভুত ভয় আমাকে আজীবন কুঁড়ে কুঁড়ে খায়! ইদানীং ট্রেন নৌকা প্লেন যাত্রাকে কে খালি একমুখী যাত্রা মনে হয়।মনে হয় সারাজীবন যে  ক’জন মিলে কোন একটা বাহনে চড়েছি নামার সময় অতজনই নেমেছি মালসামানা নিয়ে। কিন্তু এখন মনে হয় এক এক জনের গন্তব্য এক এক স্টেশনে।আমার আগের জন তার নিজস্ব স্টেশনে নেমে গেলেন, তারপর আমি একা! এরপর গুনে গুনে, পড়ে পড়ে, শুনে শুনে আমি আমার গন্তব্যে নামবো,বা নেমেছি,টিকিট কালেক্টর খনা গলায় বলে উঠলো " এটা আপনার স্টেশন নয়,ভুল স্টেশনে নেমেছেন কেন? যান,আবার ট্রেনে চড়েন,চারটা স্টেশন পরে নামবেন এরপর আরেকটা রেলগাড়ী আসবে পনেরো মিনিট পরে তার নম্বর এতো, সেই ট্রেন ধরে ছয়টা স্টেশন পরে আপনার গন্তব্য " আমি কি পারবো আমার নিজের গন্তব্যে যেতে! ভুল স্টেশনে আমার বড্ড ভয়! সত্যিকার অর্থে জীবনই এক অদেখা জার্নি, কিন্তু সঠিক স্টেশন খুঁজে পাওয়া তাও আবার একলা, বড়ই কঠিন। শেষবারের যাত্রায় তো সাথী কাউকে পাবোনা,পাবো?

ছবি: লেখকের ফেইসবুক থেকে

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199