সেই সুর সেই হাতছানি!

কনকচাঁপা

কণ্ঠশিল্পী ও লেখক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 23 Nov 2017

2120 বার পড়া হয়েছে

Shoes

শিল্পী কনকচাঁপা এবার গানের পাশাপাশি প্রাণের বাংলার পাতায় নিয়মিত লিখছেন তার জীবনের কথা। কাটাঘুড়ির মতো কিছুটা আনমনা সেসব কথা, হয়তো কিছুটা অভিমানিও। কিছুটা রৌদ্রের মতো, খানিকটা উজ্জ্বল হাসির মতো।

আমার পুরোটা শৈশব জুড়ে জড়ানো রাগ ইমন। কখনো আমি ভ্যায়রবী পুরবী কলাবতীতে ডুবে যেতাম বটে কিন্তু ইমন! একবার ঢুকলে আর বেরুবার রাস্তা পেতাম না। সারাক্ষণ ওই ধুন। বিশুদ্ধ সারেগাপাধানি’র সঙ্গে কড়ি মা বা ক্ষা আমাকে অতলে ডেকে নিয়ে যেতো। নিগূঢ় বিশুদ্ধতম শৈশব ছিল আমার এবং হয়তো ওই সময়ে আমাদের সবার। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে আর দশটা কিশোর এর মত সাদামাটা জীবন হলেও অসম্ভব দামী একটা কড়ি ক্ষা বাবা আমার হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন অনেক দামে কিনে। বলা খুব সহজ হলেও সেটা করা খুবই কঠিন ছিল তাঁর জন্য। আর্থিক ও সামাজিক অসহযোগিতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ওই একটি কড়ি মা তাকে স্বাভাবিক জীবন ও অস্বাভাবিক জীবনের মাঝামাঝি একটা বিন্দুতে মনোযোগ দেয়ার জন্য ওই অপূর্ব সুরেলা জিদ্দি কড়ি ক্ষা তাকে সহায়তা করেছে। যেমন একটি ধ্রুবতারা রাতের নিকষ আধাঁরে পথভোলা কে পথ চিনতে সাহায্য করে, তেমন। মেয়েকে এতো কষ্ট করে গান শেখাবো? এমন প্রশ্নের জবাব ওই একটি কড়ি ক্ষা। বাবার এই মানসিক অবস্থা আমি বুঝতে পারতাম। আমিও অনেক ভাবতাম, কি হবে গান শিখে, কেন গান, গান কি, আমি কে, আমার পরিবার কি এমন সব প্রশ্নের অনেক রকম উত্তর আমার মাথায় আসতো কিন্তু যখনই আমি রাগ ইমনের সুরে প্রবেশ করতাম তখন আমার সামনে পেছনে ডানে বায়ে কোন প্রশ্ন দাঁড়াতেই পারতো না। ওই একটি কড়া অথচ নরম মা, যাকে আমরা সঙ্গীত শিল্পীরা লেখার সময় ক্ষা লিখি, সেই সুরে এমন ডুবে যেতাম যে আর কিছুর সঙ্গে আমাকে মেলাতেই পারতাম না। এবং সত্যিকার অর্থেই আমি এই ইমন থেকে ইমনের ঘোর ইমনের কোমলতা থেকে বেরুতেই চাইনা। আমি জানি আমার বিত্ত, আমার শিক্ষা, আমার রক্ষনশীল পরিবার, আমার বেড়ে ওঠার ধরনের সঙ্গে আমার গানের জগতের যে দুরত্ব ছিল , সেখানে আমার বাবার ছোট্ট কঠিন সিদ্ধান্ত এবং আমার সেই কড়ি ক্ষা একই সুতায় বাঁধা ছিল। গানের ভয়ঙ্কর প্রেমে পরেই আমি এবং বাবা এই গানের জগতে উল্টো সাঁতার সাঁতরাতে চেষ্টা করেছি। বাবার সঙ্গে কোথাও গান শেষে রাত করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাদারটেকের উঁচু নীচু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বলতেন রাস্তা তো দেখাই যাচ্ছেনা, ভেবে নাও সবই বিশুদ্ধ স্বরের মত সমান কিন্তু জীবনের কোথাও একটি কড়ি ক্ষা লুকিয়ে থাকে, তা আগে থেকে ভেবেই সুর নামাতে হয়, পা ফেলতে হয়, তাহলেই আর উল্টে পড়ার ভয় থাকে না। আমি বুঝি আব্বার ও ইমন পছন্দ, তাই ইমনের উদাহরণ। কিন্তু আমি বলি আব্বা, উদাহরণ টা কেমন যেন! কড়ি মা আমার মাদারটেক এর রাস্তার খানাখন্দ না! আব্বা বলেন তাহলে? আমি বলি কড়ি মা আমার জীবন আমার আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ জীবন, আমার জীবনচক্র আর আমার গান এর মাঝখানে একটি ছোট্ট তারকা চিনহ। আব্বা চমৎকৃত হন। বলেন অপূর্ব বলেছো তো মা! আমি তো কখনোই এভাবে ভাবিনি। আসলেই, আল্লাহর যেভাবে তোমার কাছে গান গচ্ছিত রাখলেন, সেখানে গান কখনোই খানাখন্দ হতে পারেনা। গান তোমার ছোট্ট ধ্রুবতারা। নরম পেলব আঁধারে ছোট্ট দিশা। আর সেটা তোমার প্রিয় কড়ি ক্ষা! আশীর্বাদ মা গো, এই এতিমের বড়ই শখ ছিল গান গেয়ে শিল্পী হওয়া, তা কখনোই পারিনি, আমি আমার জীবন দিয়ে চেষ্টা করছি তোমাকে সে পথে নেবার, জীবনের কোন প্রতিকূলতায় হাল ছেড়োনা, এই বাবার মনের আশা পূর্ণ করো মা, তোমার উপর আমার বড়ই আশা। বাবা, আমি কখনোই হাল ছাড়ি না রোজকার হোমওয়ার্ক রোজ করা আমার নিয়মিত অভ্যাস। আমার কর্তব্য থেকে কখনোই আমি সরে আসার শিক্ষা পাইনি। আপনার মনের বাসনা পূর্ণ করার লক্ষেই আমার পথচলা তবে কি জানেন আব্বা? আমার সেই ছোট্ট নরম পেলব ধ্রুবতারা কি কড়ি ক্ষা নাকি আপনি তা এখন আমি আলাদা করে বুঝিনা। হারমোনিয়াম নিয়ে বসে সা রে গা যেতেই কড়ি ক্ষার (মা) নরম কোমল স্পষ্ট উপস্থিতি তে আমার অশ্রু ঝরে, আর তখনই আপনাকে মনে পড়ে। আব্বা, আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুন। আমিন।

ছবি: সাহানা হুদার ফেইসবুক সৌজন্যে।

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199