সরসীর আরশিতে

কনকচাঁপা

কণ্ঠশিল্পী ও লেখক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 2 May 2019

795 বার পড়া হয়েছে

Shoes

শিল্পী কনকচাঁপা এবার গানের পাশাপাশি প্রাণের বাংলার পাতায় নিয়মিত লিখছেন তার জীবনের কথা। কাটাঘুড়ির মতো কিছুটা আনমনা সেসব কথা, হয়তো কিছুটা অভিমানিও। কিছুটা রৌদ্রের মতো, খানিকটা উজ্জ্বল হাসির মতো।

ওস্তাদজীর সঙ্গে

 ছোটবেলায় বাবার কাছে তারপর ওস্তাদজীর কাছে যা শিখেছি তাতে তাদের ছাপ অর্থাৎ গায়নভঙ্গী একদম কার্বন পেপারের মত আমার কন্ঠে বসে যেতো। বাবার কন্ঠের দানাদার কারুকাজ এমন ভাবে বসতো যে বোঝাই যেতো কে গান শিখিয়েছেন।আব্বা তাতে খুবই খুশী হতেন।ওস্তাদজীর কন্ঠের কারুকাজ ও একইভাবে বসে যেতো। ওস্তাদজীর কাছে মাত্রই শেখা শুরু করেছি।সা রে গা মা পা গাইতেও এক একজনের এক এক স্টাইল থাকে।শ্রদ্ধেয় গীতিকার ফজলে খোদা কাকাই তো ওস্তাদজী জনাব বশীর আহমেদের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। উনিই একদিন বললেন এই মেয়ের গলায় বশীর ভাইয়ের ছাপ বসে যাচ্ছে মাশআল্লাহ। তারমানে কি! তারমানে যা-ই শিখি না কেন আসলে শেখার চাইতে নকলই বেশী হয়।অনুকরণ আর কি।এটা যে ভালো নয় তা বোঝালেন আব্দুল লতিফ চাচা,আমাদের গনসঙ্গীতের দিকপাল। বারবার বোঝাতেন অনুসরণ করো, অনুকরণ নয়।নিজের মত গাও।কিন্তু আমি তো একটু তোতাপাখি। আমি নিজেও বুঝি।একসময় কৈশোরে পা দিয়ে হৈমন্তী শুক্লাতে মজে গেলাম। শুধু মজে নয়, মজে গিয়ে ডুবে ভেসে ভেসে ডুবে মরছিলাম আরকি।হৈমন্তী দিদির নিঃশ্বাসের সুগভীর ওঠানামার অনু-পরমাণুও গিলে খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো নিজের অজান্তে।যদিও বাবার উৎসাহে লতা মুঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখার্জি, ফেরদৌসী রহমান, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা সব শিখতাম।

পুরুষ কণ্ঠশিল্পী ও বাদ যেতো না।মান্নাদে, সতীনাথ, জগন্ময় মিত্র, মানবেন্দ্র সবই গাইতাম। কিন্তু মন পড়ে থাকতো হৈমন্তী শুক্লা তে। মোটামুটি বাংলাদেশের হৈমন্তী হওয়ার পথে হাঁটছিলাম। কিন্তু ডন কোম্পানির গান দীর্ঘকাল গাইতে গিয়ে আমি আমার নিজের ভেতরের হৈমন্তী কে ছেড়ে বেরিয়ে এসে যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করার সাহস পাচ্ছিলাম। এক একটা রেকর্ডিং এ এক একজনের গান গেয়েছি, গেয়েছি নজরুল সংগীত, লালনের গান, পল্লীগীতি, হাসনের গান, হিন্দি গান।এতো ভ্যারাইটির গান গাইতে গাইতে আমি একটু একটু হৈমন্তী দিদিকে ভুলে যাচ্ছিলাম, নাকি সরে যাচ্ছিলাম তা এখন ঠিক মনে পড়ছেনা।তবে একজন ফেরদৌসী রহমানের শ্বাস-প্রশ্বাস বিশাল দমের খেলা, আরতি ধরের সরল জলের ধারা, শাহনাজ রহমতুল্লাহর কামনার আহাজারি আমাকে দমে দমে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে শুধু হৈমন্তী নয়, এদিকেও তাকাও, বুঝে নাও, গান কত রঙের হয়!

ওস্তাজীর কাছে তালিম নিচ্ছি

হঠাৎ আমার কন্ঠের আগল বন্যার পানির মতো খুলে গেলো। বলা যায় একটি ঘরানার আড়ষ্টতা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করলো আমার কন্ঠ।কিন্তু হৈমন্তী দিদির প্রতি ভালবাসা? তা রয়ে গেলো প্রথম প্রেমের অনুভবের মতই।

 নিজের পারঙ্গম ক্ষমতার সঙ্গে যখন অধ্যাবসায় সততা ধৈর্য মেশানো যায় তখন তা থেকে কিছু ফলাফল অবশ্যই আশা করা যায়।সেই অধ্যাবসায় এর ফলাফল হিসেবেই আমি কিছু নতুন দিগন্তের দেখা পেতে শুরু করলাম। এখন এভাবে ব্যাখ্যা সহ বলতে পারছি সহজে। তখন কিন্তু এভাবে ভাবতে, বলতে পারিনি।তখন ছিলো শুধুই অধ্যাবসায় আর অধ্যাবসায়। অপেক্ষা হয়তো ছিলো, কিন্তু ছিলো না আক্ষেপ আর হতাশা। হতাশা এসে গেলে হয়তো স্বাস্থ্যসেবার মাঠকর্মীই হয়ে যেতাম।

সেই চুরাশি সালে এক সপ্তাহে তিনজন বাঘা বাঘা মিউজিক ডিরেক্টরের আটটি গান গাওয়ার পর অনুচ্চারিত অবাঞ্চিত ঘোষিত হওয়ার পর বিরানব্বই সালে আমাকে আবার সিনেমার গান বা প্লেব্যাক করতে ডাকলেন বেদের মেয়ে জোৎস্না ছবির বিখ্যাত মিউজিক ডিরেক্টর শ্রদ্ধেয় আবু তাহের ভাই।খুব আশ্চর্য কথা যে স্যাড মেলোডি গানের রেগুলার শিল্পীকে তিনি খুব নির্ভরতা নিয়ে গাইতে ডাকলেন চটুল একটি গানের জন্য। ‘তুমি আমার’ ছবিতে গাইলাম ‘দেখা না হলে একদিন কথা না হলে একদিন বুকের ভেতর করে চিনচিনচিনে।’

 সেটাও আমার একটা অনন্য মাইলফলক হয়ে দাঁড়ালো বটে।কৃতজ্ঞতা তাহের ভাই, আমাকে নতুন ভাবে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

ছবি: লেখক

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199