সেই যে আমার আঁধার ছাওয়া দিন গুলো

কনকচাঁপা

কণ্ঠশিল্পী ও লেখক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 19 Sept 2024

1330 বার পড়া হয়েছে

Shoes

শিল্পী কনকচাঁপা এবার গানের পাশাপাশি প্রাণের বাংলার পাতায় নিয়মিত লিখছেন তার জীবনের কথা। কাটাঘুড়ির মতো কিছুটা আনমনা সেসব কথা, হয়তো কিছুটা অভিমানিও। কিছুটা রৌদ্রের মতো, খানিকটা উজ্জ্বল হাসির মতো।

২০ সালের মার্চের মাঝামাঝি, করোনার থাবা সারা পৃথিবীর বুকে কাঁকড়ার ক্লর মতো কেচকি দিয়ে টুটি আটকে ধরলো। সারা পৃথিবীতে লন্ডন আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া নরওয়ে দুবাই সহ প্রায় এগারোটা প্রোগ্রাম এক ধাক্কায় ক্যানসেল হয়ে গেলো। খুব ভেঙে পড়লাম বলা যায়না। আমি আল্লাহ ছাড়া আর কিছু ভয় পাইনা। ভয় তো পেলামই না বরং বলা যায় জীবনে প্রথম অখণ্ড অবসর পেলাম।

কিন্তু কিছু ভাবনা মাথায় আসছিলো। যেমন ১৮ ডিসেম্বর এর নির্বাচনের পরে আমার কাজকর্ম কিছু কিছু কমে যাচ্ছিলো। প্রোগ্রাম আসে, কিন্তু ক্যান্সেল হয়। এই ব্যাপার নিয়ে গবেষণার সময় পাইনি তাই বোকা আমি টের পাইনি।অবসর পেয়েই এই ভাবনার ফলাফল বুঝলাম যে নির্বাচন করেছি দেখেই আমাকে আর অনুষ্ঠানে নেয়া হচ্ছে না।হঠাৎ দুয়েকটা অনুষ্ঠান তাও মনে হয় কারো দয়ার উপর নির্ভর করে হচ্ছে।

বিটিভি তো ১৪ সাল থেকেই ডাকে না,অন্য টিভি চ্যানেল গুলোও স্লো পয়জনিং এর মতো করে কাজ করা শুরু করছে।মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান আসে,বাজেট শোনে, তারপর একদিন ক্যান্সেল হয়। এভাবে বছর বছর পার হয়।

হাতের টাকাকড়ি খুব সাবধানে খরচ করার কথা মনে আসে।কিন্তু পারি আর কই।বিয়ে শাদী জন্মদিনের দাওয়াত এলে এড়িয়ে যাই কারণ আমি কনকচাঁপা! লামসাম উপহার তো দেয়া চলে না,আমার নিজের একটা মানইজ্জত আছে না? এভাবে কখনও কখনও দম আটকে আসে।নিজের উপর নিজে বিরক্ত হই।

কিন্তু আল্লাহ নদীর এ পাড় ভেঙে দিয়ে ওপারে জমিন বানিয়ে দেন।এই জীবনের সর্বোচ্চ বিদেশ ট্যুরে অংশ গ্রহণ করি আমি এই সাতবছরে। এপ্রিল মে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আমেরিকা কানাডা লন্ডন অস্ট্রেলিয়া সিংগাপুর। কিন্তু সেই ট্যুরের ইনকাম দিয়ে পুরো বছর যায় না,যেতে চায় না।মানুষ ভাবে এতো বড় শিল্পী, তিনি তো টাকা দিয়ে তোশক বানিয়ে ঘুমান।আসলেই কি তাই?

ইদানীং শিল্পীদের মাঝেও সৎ অসৎ আছে।তদবির সহ নানা কিছু করে নিজেদের অর্থবিত্ত বাড়ান কোন কোন শিল্পী। কিন্তু আমার সামনে এক সমুদ্র সম্ভাবনা উন্মুক্ত করে রাখলেও তা থেকে চুপিসারে এক মুঠো তুলে নেয়া কখনো সম্ভব নয়।না পরিবার থেকে শিখেছি না আমার স্বামী শিখিয়েছেন। এবং আমি নিজেও তা কখনও দু:স্বপেও ভাবিনা।

এভাবে কোন মতে দিন যেতে যেতে একদিন অনুভব করলাম পুরো শিল্পী জাতিই আমাকে ত্যাগ করেছে। এবং সাংবাদিক গনও।একমাত্র তারেক আনন্দ ছাড়া আর কেউই আমার কোন সংবাদ ছাপতো না।আমি ততদিনে সব বুঝে গেছি।কিন্তু অবশ্যই ভেবেছি রাত যতই গভীর হয় ভোর তত কাছে আসে।আমার অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি খুবই নিম্নবিত্তের মতো হয়ে যায়।আমি এবং আমরা ভয় পাইনা। ভাবি আল্লাহতাআলা একটা রাস্তার কুকুরেরও রিজিক নির্ধারণ করে রেখেছে। আমাদের রিজিক ও তিনিই দিবেন। কখনও এভাবে ভাবি,কখনও কাঁদি।গান গাইবার জন্য পিপাসায় ছটফট করি। কতদিন ভালো কাপড় পরে মঞ্চে দাঁড়াইনি এই কথাও মনে আসে।ফেসবুকে আমার সঙ্গে প্রায় একশো শিল্পী সেলিব্রিটি বিনোদনকারী যুক্ত রয়েছে তারা কখনো আমার লেখা ছবিতে কমেন্ট করে না এমনকি শিল্পীদের নিয়ে কথা বললেও না।তারা নিজহাতে আমাকে আনফলো করেছে বুঝতে পারি।

আমি আনন্দিত থাকার নতুন অভ্যাস করি। ফুলপাখী লতাপাতা নিয়ে ব্যাস্ত থাকি। এই নিরবচ্ছিন্ন অবসরে নাতনাতনিদের নিবিড় সময় দেই যা পেশাদার জীবনের ব্যস্ততায় নিজের ছেলেমেয়েদের দিতে পারিনি। কিছু বই লিস্ট করে কিনে পড়ে পড়ে শেষ করি।নিবিড় ভাবে কয়েকজন লেখকের অনুবাদ করা বাংলা কুরআন মজিদ পড়ি।

ছবি আঁকি,রান্নার চ্যানেল খুলি,তা থেকে মাসে মাসে কিছু পয়সা আয় করি।যদিও রান্না সারাজীবনই করেছি কিন্তু ঘরের জন্য রান্না আর ভিডিওর জন্য রান্না দুই ব্যাপার। পাবলিক অনেক ধরনের কমেন্ট করেন।কেউ উৎসাহ দেন,কেউ ছিছিক্কার করেন। আমি ধৈর্য ধরে প্রশংসা টুকু নিজের করে নেই। আল্লাহর আঁকা চিত্রকল্প বোঝা বড় দায়।এতো দিন দর্শক শুধু গান শুনেছেন। তারা এবার রান্নার ফাঁকে ফাঁকে আমার আলাপচারিতার প্রেমে পড়েন। তাঁরা খুব সাধারণ রান্নার মাঝের এই গল্পগুলোকেও ভালোবেসে ফেলেন।তাঁরা আবিস্কার করেন আমি শুধু সাদামাটা নই অভিজাত ও বটে।আমি তাঁদের কমেন্ট এ মেল্ট হয়ে যাই।আরও কৃতজ্ঞ হয়ে যাই।তাঁদের নিরলস ভালোবাসায় আমি অভিভূত!

এভাবে চলতে চলতে মেয়েজামাই বলেন আপনার বগুড়ায় একটা জমি আছে না? অনেক গাছগাছালি সেখানে। ওখানে বাড়ি করেন। এভাবে কর্মহীন হয়ে ঢাকায় বন্দী না থেকে বগুড়াতেই থাকেন। যেই ভাবা সেই কাজ।এবং সত্যি সত্যি আমি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বাসস্থান আবিষ্কার করি।বগুড়ায় বাড়ি করে সেখানেই বসবাস শুরু করি।

ততদিনে আমি জেনে গেছি রেডিওতেও আমার গান বাজে না।রাস্তায় কোন দ্রব্যাদি বিক্রেতা মাইকে গান বাজালে কিশোরদার অংশ টুকু বাজায়।আমার অংশ কেটে দেয়।বিটিভিতে নতুনরা আমার গান গাইতে চাইলে নিষেধ করে।ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে আমাকে তারা বেঁচে থাকতে দিয়েছে সেটাই ঢের বেশি।

 সত্যমিথ্যা জানিনা,রেডিওতে আমার গান ভুলে বাজিয়ে দুইজন মানুষ সাসপেন্ডও হয়েছে বলে শুনেছি।আবার এ ও জেনেছি যে যত রেডিও টিভিতে আমার গান বন্ধ করে ততই মানুষ ব্যাক্তিগত মোবাইলে আমার গান বেশি করে শোনে।সুঅভিনেত্রী শাবনূর আবারও অভিনয়ে ফেরে, তখন লাখো দর্শক ফেসবুকে জোর দাবি জানায় যে শাবনূরের লিপে আমার গান ছাড়া কারো গান তারা শুনতে চায়না কিন্তু নির্মাতারা নির্লিপ্ত। কমেন্টকারী আমার,শাবনূরের ও নির্মাতাদের পার্সোনাল, অফিসিয়াল পেইজে লিখেই যায় নিরলসভাবে।

কিন্তু সবার এমন ধারণা যেন কনকচাঁপা বলে কেউ কখনও ছিলো না।

এর মধ্যে সাংবাদিক গীতিকার জাহিদ আকবর শ্রদ্ধাভরে আমাকে ও আমার হাজব্যন্ড সংগীত পরিচালক মইনুল ইসলাম খান সাহেবকে একটা অ্যাওয়ার্ড গিভিং অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানায়।একটু দ্বিধা নিয়েও যাই,ভাবি কি আর হবে, কেউ তো আর মারবে না! যাওয়ার পরে দেখলাম এক হল ভর্তি সব নতুন পুরাতন শিল্পী, গানের ও অভিনয় জগতের।

কিন্তু হঠাৎ আবিষ্কার করলাম কেউ আমাকে দেখছেনা।আমি যেন ভুত।আমাকে দেখা যায় না।গানের জগতে তো বটেই অভিনয় জগতের রথী মহারথীরাও  যারা হুমড়ি খেয়ে বুকে জড়াতো আজীবন তারা আমাকে চোখেই দেখছেনা।সেদিন খুব আঘাত পেয়েছিলাম। শিল্পীরা এমন হয়? আস্তে করে বের হয়ে এলাম।

সেদিন বাসায় ফেরার পথে অনেক কেঁদেছি।নিজের উপর অনেক ঘৃণা হয়েছে। কেন ব্যাপারটা এভাবে বুঝিনি আগে! আমি কী অন্যায় করেছি! পারলো সবাই এমন করতে? আমার কি রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে না? সবাই যদি এক মতের হয় তাহলে ভোটাভুটি আছে কি করতে!

আমি সারাজীবন ভালোবাসা পেয়েই এসেছি, সেদিন দেখলাম ভালোবাসার পাশেই থাকে অপার ঘৃণা! নিজেকে সম্পুর্ন রূপে সরিয়ে নিলাম। সারাজীবনের জন্য হয়তো। তবে ৭ বছরে আমাকে যে অনুচ্চারিত অত্যাচার করা হয়েছে তাতে আমি অনেক পরিপক্ব হয়েছি,মিতব্যয়ী হয়েছি,ধৈর্য বেড়ে গেছে,আমি পরিনত হয়েছি।শিশুর সারল্য আমি হারাইনি কিন্তু ছেলে ভুলানোর গল্প আমাকে আর কেউ বলতে পারবেনা। এবং নিপুণ ভাবে সাজানো স্নানঘর কাম টয়লেটের নীচে থাকা পয়োবর্জের ভাণ্ডার ও দেখেছি। অনেক কিছুই একজীবনে অভিজ্ঞতা হয়ে গেলো আলহামদুলিল্লাহ।

কিন্তু আমার সিলেবাসে প্রতিশোধ বলে শব্দ নেই।আমি শুধরে যাওয়াতে বিশ্বাসী।এই পৃথিবীর তথা বাংলাদেশের সব ভুল গুলো শুধরে যাক,বাংলাদেশকে বেহেশত হতে হবে না,শুধু মিথ্যাচার মুক্ত বাংলাদেশ হোক,এটাই আমার চাওয়া। আর আল্লাহ যেন আমার ভালো হয় এমন কিছুই বরাদ্দ করেন এই দোয়াই চাই সবার কাছে।

এবং সবশেষ চাওয়া, বাংলাদেশের শিল্পীরা সত্যিকারের শিল্পী হয়ে উঠুক। কারণ শিল্পীদের নামের পাশে দুর্নীতি চুরি ঘুষ পাচাটা দালাল এগুলো শব্দ মানায় না।

আর এই দু:সময়ে আত্মীয় স্বজনরা? যদিও আত্মীয় স্বজনের ডেফিনেশন আজও জানিনা।একমাত্র মা বোনরা ছাড়া কেউ একটা বারের জন্য ও জিজ্ঞেস করে নাই কনক,তোমরা কেমন আছো,কি খেয়ে জীবন পার করছো।অথচ তারা সবই জানে কিন্তু কেউ কেউ এই কথা জানাতে ভোলে নাই যে আমার পরিচয়ে তাদের অসুবিধা হয় অতএব যোগাযোগ না করাই উত্তম ! অথচ আজ তারা শুভকামনা জানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।তাজ্জব! কিছু বন্ধ দুয়ার আর কখনো খোলে না এটা তারা ভুলে গেছে! যাইহোক।

সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

ছবি : লেখকের ফেইসবুক থেকে

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199