আমি অতদিন বাঁচতে চাইনা

কনকচাঁপা

কণ্ঠশিল্পী ও লেখক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 4 Feb 2021

1395 বার পড়া হয়েছে

Shoes

শিল্পী কনকচাঁপা এবার গানের পাশাপাশি প্রাণের বাংলার পাতায় নিয়মিত লিখছেন তার জীবনের কথা। কাটাঘুড়ির মতো কিছুটা আনমনা সেসব কথা, হয়তো কিছুটা অভিমানিও। কিছুটা রৌদ্রের মতো, খানিকটা উজ্জ্বল হাসির মতো।

গত বৃহস্পতিবার চলে গেলেন আমাদের সঙ্গীত জগতের অন্যতম প্রধান ওস্তাদদের একজন সঞ্জীব দে। তার মৃত্যুতে আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। তিঁনি যতবড় জাননেওয়ালা সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন তারচেয়েও বড় ধরনের ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় চ্যানেল আই সেরাকণ্ঠের প্রতিযোগিতার প্রথম দিকের বাছাইয়ে সারা বাংলাদেশের বাছাইপর্বে।অনেক শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক একসময় সারা দেশময় ঘোরার সময় সবাইকেই আলাদা করে বোঝা যেতো কিন্তু উনি কেমন যেন ক্যামোফ্লাজ হয়ে যেতেন। বিনয়ের অবতার একদম। হঠাৎ সিলেটের পথে মধ্য যাত্রাবিরতিতে উনি পাশের চেয়ারে বসে খেতে খেতে বললেন কনকচাঁপা আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে,আমি হেসে বললাম অনুরোধ! বলেন প্লিজ। উনি বললেন, ‘আরতি মুখোপাধ্যায় এর গাওয়া এ চারুকেশে সুচারু কবরী গানটি আপনি জানেন?’ বললাম, ‘জী দাদা’।উনি বললেন, ‘তাহলে এই গান আপনি পুরনো দিনের গান হিসেবে রেকর্ড করেন। আপনার কণ্ঠে দারুণ হবে।’ আমি খুবই আনন্দিত হলাম যে উনি আমাকে চেনেন বলে। এরপর আর দেখা হয়নি কখনও কিন্তু অনেকেই আমার কাছে গান শিখতে চাইলে আমি যে কয়েকজন এর কাছে পাঠিয়ে থাকি ( আমি এখনো নিজেকে গান শেখানোর যোগ্য ভাবিনা) তার মধ্যে উনিই প্রধান।

বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর কাছে আমার প্রশ্ন, আপনারা যে চ্যানেলগুলো চালান, গান বাজনা দিয়ে টিআরপি বাড়ান, আপনাদের কি কোন সামাজিক দায় নেই? ভালো সঙ্গীতচর্চা, সংস্কৃতির চর্চা বিষয়ক কোন দায়বদ্ধতা আপনাদের নেই? যারা বিভিন্ন চ্যানেলে গানের কাজ করেন তারা বাংলাদেশের সঙ্গীতের ইতিহাস, শিল্পীদের কোয়ালিটির ভালো মন্দ, সিনিয়র জুনিয়র শিল্পীদের সিরিয়াল জানেন? প্রতিটি মিডিয়ার গান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে প্রশ্ন ( চ্যানেল আই বাদে) আলুপটল ব্যবসায়ী আর সংগীত এর মতো সুকুমার বৃত্তি নিয়ে কাজকর্ম করার পার্থক্য বোঝেন আপনারা? বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের ব্যাক্তিগত ফোন মোবাইল নম্বর আপনাদের কাছে আছে? সঞ্জীব দে কে চিনতেন? তার অবদান জানেন? কারা কারা তাঁর ছাত্রছাত্রী ছিলেন আন্দাজ আছে? সঞ্জীব’দার বাবা ছিলেন এই উপমহাদেশের জ্ঞানী সঙ্গীতজ্ঞ শ্রদ্ধেয় মিথুন দে।বলাই বাহুল্য তাঁর বাবার মতই খুব নিরবে সঞ্জীব’দাও চলে গেলেন। এবং তা নিয়ে কোনো চ্যানেলেই কোন সংবাদ ছিলো না বলা যায়। এসব ব্যাপারে খুবই অভিমান হয়,নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়,মনে হয় আমি এবং আমরাই দায়ী। উচ্চাঙ্গসংগীত, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কোন কদর কখনো বাংলাদেশে তেমন ভাবে ছিলো না। কাদা পলির দেশ,এখানে হয়তো উচ্চাঙ্গসংগীত ঠিকঠাক জমে উঠতে পারেনা তাই এর প্রসার ও কম।হতেই পারে কিন্তু উচ্চাঙ্গসংগীত যে আমাদের সঙ্গীত চর্চার জন্য অপরিহার্য বিষয় তা কি আমরা ভুলে যাবো? আমাদের এই সঙ্গীত জগৎ কিন্তু এখন ভালোই বড় হয়েছে এবং অনেক শিল্পী প্রতিষ্ঠিত হয়ে এই গানকেই পেশা হিসেবে নিয়েছে,নিয়েছি এবং ভবিষ্যতেও অনেকেই পেশা হিসেবে নিতে ইচ্ছুক। কিন্তু সেই গানের ভিত গড়ে দেয়ার "উচ্চাঙ্গসংগীত" শেখানোর মানুষ কই? খুবই অল্প কয়জন জাননেওয়ালা ওস্তাদ ছিলেন তাঁরা ওপারে চলে গেছেন। কেউ কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছেন কেউ পেশা বদল করেছেন কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন কারণ তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করার কেউ নাই অথচ কি না তাঁদেরও ভাত খেতে হয়, বাজার করতে হয়! সরকার ইচ্ছে করলেই এই গুনী মানুষদের একটু দেখাশোনা করে তাঁদের জীবন সহজ করে দিতে পারেন।এবং তা যে এই ত্রিভঙ্গমুরারি মিডিয়ার জন্য কতো উপকারী হবে তা কেউই যেন বুঝেও বুঝে উঠতে পারছে না।

আমি সব কিছু নিয়ে খুবই আশাবাদী কিন্তু খুব হতাশার সঙ্গে গত কয় বছর ধরে এই জগতের বন্ধ্যাত্ব লক্ষ্য করছি।হঠাৎ করে অনেক সঙ্গীত পরিচালক চলে গেলেন, ছবির জগৎ এলোমেলো, সিডি বিক্রি হয়না, তার উপর করোনা এসে শেষ পেরেক ঠোকার বুদ্ধি! অথচ কতো প্রতিভাময় কণ্ঠ জন্ম নিচ্ছে! তারা ঘুরেফিরে সেই পুরনো গান গুলোই গাচ্ছে এমনকি ছবিতেও পুরনো গান,গানের একাংশ জুড়ে দেয়া হচ্ছে।এগুলো সত্যিই বন্ধ্যাত্বের স্পষ্ট লক্ষ্মণ। তার উপর শিল্পীর কণ্ঠ, আচার আচরণ, শেখানোর জন্য বিজ্ঞ শিক্ষিত সঙ্গীতজ্ঞের অভাব আমাদের এইসব হতে চাওয়া শিল্পীদের দেউলিয়া করে দিচ্ছে।শিখতে না পেরে উপায়হীন হয়ে ঝা চকচকে চ্যানেলের অনুষ্ঠানে,বিয়ে বাড়িতে, এর চিলেকোঠায় ওর গ্যারেজে শিল্পীরা মজমা জমাচ্ছে! বিভিন্ন চ্যানেলের লাইভে সুরে বেসুরে অসুরে যা ঘটছে তার চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু নাই। এই অবস্থা ঠিক করা না গেলেও কিছু মেরামত করার জন্য আমাদের পিছনে ফিরে সেই গোড়া থেকে তৈরি হওয়ার জন্য একজন সঞ্জীব’দের কাছে ফিরে যেতে হবে।কিন্তু তাঁরা তো অভিমান নিয়ে নিরবে চলে যাচ্ছেন, যাওয়ার সময় যদি অভিশাপ দিয়ে যান তো আমরা কোথায় দাঁড়াবো! আমি যেমন সঙ্গীত এবং উচ্চাঙ্গসংগীত শিখেছি বাংলাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী জনাব বশীর আহমেদ সাহেবের কাছে।তিনি কি আমাকে শুধুই সঙ্গীত শিখিয়েছেন? না,তিনি আমাকে সঙ্গীত বাদেও একজন শিল্পীর জীবনাচার শিখিয়েছেন, ভুলভাল করলে তিনি শাসন করেছেন কড়া ভাবে এবং তা আরও পাকাপোক্ত করতে আমার বাবা আরও শাসন করেছেন। সেই শাসন এর বেড়াজাল আমি আজো ডিঙ্গাতে পারিনি।আজও কোন পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করার আগে আমি ভাবি আমার মা কি বলবেন অথচ কিনা আমি মধ্যবয়সী একজন মানুষ। আমাদের শিল্পীদের উচ্চাঙ্গসংগীত, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সাধনার সঙ্গে সঙ্গে একটু সার্বিক শাসন দরকার। তারজন্য প্রয়োজন অনেক জন সঞ্জীব’দে। কিন্তু তারা যদি অভিমান করেন তো তার ফলাফল হিসেবে গান নীচে নামতে নামতে হীরো আলম পর্যন্ত বলবে "এগুলো হচ্ছেটা কি! ছি ছি ছি এগুলো গান!" আমি অতদিন বাঁচতে চাইনা।

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199