ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাবো

কনকচাঁপা

কণ্ঠশিল্পী ও লেখক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 13 Feb 2020

1195 বার পড়া হয়েছে

Shoes

শিল্পী কনকচাঁপা এবার গানের পাশাপাশি প্রাণের বাংলার পাতায় নিয়মিত লিখছেন তার জীবনের কথা। কাটাঘুড়ির মতো কিছুটা আনমনা সেসব কথা, হয়তো কিছুটা অভিমানিও। কিছুটা রৌদ্রের মতো, খানিকটা উজ্জ্বল হাসির মতো।

ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শুরু হয়েছে যখন পুরো দমে আমিও ঠিক তখন ভয়াবহ ব্যাস্ত হয়ে গেলাম।বাসা আমার মহানগর প্রজেক্টে। বাসাবো বাসায় আমাদের ফোনের লাইন ফেলে রেখে আমেরিকা গিয়েছিলাম। কিন্তু এতো ব্যাস্ত আমরা যে ফোনের লাইন অ্যাপ্লিকেশন করে ঠিকানা বদল করার সময় আমাদের নেই।কিন্তু সে সময়েই আমার সর্বোচ্চ সিনেমার গান।আনন্দ অস্রু, বিয়ের ফুল, প্রানের চেয়ে প্রিয় ইত্যাদি সুপার ডুপার হিট গানের ছবিতে গান গেয়েছি। আমার গানগুলোও আকাশে বাতাসে বাজছে।কিন্তু আমি পড়ে আছি মহাসাগরের মধ্যে একটা ছোট দ্বীপে! আমাদের গায়ক আবু সাঈদ জাহাঙ্গীর ভাই এবং পাশের ফ্ল্যাটে বিশিষ্ট গিটারবাদক এবং সংগীত পরিচালক রিচার্ড কিশোর’দা ছাড়া অত্র অঞ্চলে আমাদের কোন পরিচিত কেউ ছিলো না। আমাদের ফোন আসতো জাহাঙ্গীর ভাইয়ের বাসায়।পাশের বিল্ডিং ওনার বাসা,সেখান থেকেই জাহাঙ্গীর ভাই জোরে ডাকতেন এবং বলতেন মইনুল ভাই ------- বুলবুল ভাই অথবা আলী ভাই বা আলম ভাই,মানে যখন যার ডাক আসতো, অমক স্টুডিওতে অতটার সময় যেতে বলেছেন। আমরা সময় মতো যেতাম। গিয়ে গান করে ফিরতেই জাহাঙ্গীর ভাই আবারও হয়তো ডাকতেন মইনুল ভাইইইইইই---- আপনাদের অমুক স্টুডিওতে ডেকেছেন। তখন সেটা জীবনের এবং পেশার একটা সাধারণ অংশ ছিলো কিন্তু এখন যখন লিখছি তখন নিজের কাছেই খুব বিস্ময়কর লাগছে গল্পটা! ঠিক ওই সময় আমার একটা ব্যাগ ছিলো ভীষণ প্রিয়। হাতব্যাগ অনেক বড় আমার কখনো প্রিয় না।আমার গানের খাতা এঁটে যায় এমন একটি ব্যাগ হলেই আমার হয়ে যায়।সে ব্যাগটি আমি লস এঞ্জেলেস থেকে কিনেছিলাম। এক এক দিন দুই তিনটা রেকর্ডিং স্টুডিওতে গান গেয়ে আমার ব্যাগ টাকায় ভরে যেতো।ব্যাগের পেট ফুলে যেতো। যদিও কখনো সে টাকা দিয়ে আমার শাড়িজামা টয়লেট্রিজ জুতা ইত্যাদি বিলাসী দ্রব্য কেনার ইচ্ছে আকুলিবিকুলি করতো না।তখন থেকেই আমি আমার বাড়তি উপার্জন দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি।প্রথম আলো তখন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের পরে একটা প্রতিবেদন দিতো।সেখানে দরিদ্র ছাত্রদের ভালো ফলাফলের সুখবর এবং পরবর্তী পড়াশোনার উদ্বেগ এর গল্প লেখা থাকতো। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে যেতাম। আমার হাজব্যান্ড আমার উৎকন্ঠা দেখে বলতেন চলো আমরা প্রথম আলোর অফিসে গিয়ে কিছু টাকা ছাত্রদের দিয়ে আসি।আমার গ্রামের বাড়িতে নদী ভাঙা হতদরিদ্র মানুষের কথাও মানসপটে ভেসে উঠতো। আমার নিজের কত আআত্মীয়স্বজন হতদরিদ্র! আমি দুইটা পরিবারকে নিয়মিত মাসিক ভাতা চালু করলাম।যোগাযোগ এর অনুন্নত অবস্থায় তখন এগুলো খুব কঠিন কাজ ছিলো। মাসিক ভাতা না দিয়ে একবারে ছয়মাস অথবা বছরের টাকা দিয়ে দিলে আমার জন্য সোজা হতো কিন্তু দরিদ্র পরিবার যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরানো দূরের কথা নুন দিয়ে মাখানোর জন্য যেখানে কোন পান্তাই থাকেনা সে ঘরে বছরের টাকা দুইদিনেই ফুরিয়ে যাওয়ার আশংকায় আমি কতই না কায়দা করতাম।টাকা আমি আমার বড় বোন বগুড়ার ধুনটে থাকেন সেখানে পাঠাতাম।আপা প্রত্যেক মাসের পয়লা দিকে তাদের বাড়ি গিয়ে গিয়ে দিয়ে আসতেন। আমার বাবার চাচাতো ভাই একজন কুষ্ঠ রোগী। ছয়ফুট লম্বা মানুষ হাত পা খুইয়ে আড়াই ফুট হয়ে গেছেন। তার পরিবারকে ভাতা দেয়া শুরু করলাম। এই কথা আমার মায়ের মাধ্যমে আমার মেঝমামা শুনলেন। তিনি বিস্মিত,এভাবেও মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়! আগে তিনি নাকি কখনওই ভেবে দেখেননি। মামা খুব আনন্দিত হয়ে আমার এইসব কাজে যোগ দিলেন। সুদূর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে তিনি আমাকে টাকা পাঠাতে লাগলেন। আমি আরও বড় পরিসরে ছাত্রদের বৃত্তি এবং পারিবারিক ভাতা, কারো কারো মেয়ের বিয়ে, চিকিৎসা এগুলো কাজের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। আমার আয় বাড়লেও আমাদের প্রয়োজনীয় কিছু যেমন গাড়ি টেলিফোন ইত্যাদি ছাড়া জীবন যাত্রা আগের মতই রাখলাম। বেড়ে গেলো অন্য মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজগুলি।

এই ধরনের কাজের প্রশান্তি? যে করে সেই বোঝে। আমার মায়ের বাড়ি ঢাকার প্রত্যন্ত অঞ্চল মাদারটেক এর দক্ষিনগাঁ।সেখানে যাওয়ার পথে দেখি রাস্তার পাশের বাজারঘাট। একদিন দেখি কুপির আলোয় হকার কম্বল বিক্রি করছেন। বাসায় গিয়ে আম্মার প্রতিবেশী জালাল, যে আম্মার কাছে বড় হয়েছে, তাকে পাঠালাম কম্বলের দাম শুনে আসতে। আমি বিশটি কম্বল কিনলাম। সেই থেকে আমার শীতের কাপড় বিতরণ শুরু হলো। পরের বছর আর মাদারটেক নয়, বঙ্গবাজার থেকে একশো কম্বল কিনলাম। কিন্তু বিতরণ করা খুব কঠিন কাজ।আমি সৌভাগ্যভান, শুধু গান নয়, আমার স্বামী আমার সব ভালো কাজে হাত লাগান।আমার ভাবনাগুলো তাকে স্পর্শ করে, এটা তার প্রতি গভীর ভালোবাসায় নিমজ্জনের একটা বড় কারণ। আমরা শুধু কাপড় বিতরণ নয়, কাপড়ের বস্তা নিয়ে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামেও দিয়ে আসতাম। সে সময় থেকেই আমি প্রথম আলো সহ অন্যান্য জাতীয় দৈনিক এ লেখালেখি শুরু করলাম। সামাজিক সমস্ত অসঙ্গতিপূর্ণ ব্যাপার চোখে পড়লে আমার রাগান্বিত দুঃখিত মানসিক অবস্থা দেখলেই উনি বলতেন তুমি লেখো, আমি দৈনিক পত্রিকা অফিসে দিয়ে আসি।আমার লেখা পড়ে প্রথম আলোর মতিউর রহমান ভাই, কবির বকুল ওরাও কোন বিষয়ে লিখতে বলতো।প্রতিবাদী আমি অনেক বিষয়েই লেখা শুরু করলাম।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে সব সময়ই থাকতো গান গাওয়া এবং সুর সাধনা। পথ চলার জন্য এটাই আমার একমাত্র সম্বল।আমি আমার সেই একমাত্র সম্বল এবং স্রষ্টার প্রতি, তাঁর রহমতের প্রতি অবিচল আস্থা ও পরিবারের সমর্থন নিয়েই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে থাকলাম।আমি একজন হতে চাওয়া শিল্পী কিন্তু কন্ঠশ্রমিক হয়ে গেলাম এই আশা নিয়ে যে এই কন্ঠশ্রমিকই একদিন নিশ্চয়ই আমি শিল্পী হয়ে উঠবো ইনশাআল্লাহ।

ছবি: লেখকের ফেইসবুক থেকে

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199