যদি তাঁর দেখা পাই

কনকচাঁপা

কণ্ঠশিল্পী ও লেখক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 18 Jan 2018

955 বার পড়া হয়েছে

Shoes

শিল্পী কনকচাঁপা এবার গানের পাশাপাশি প্রাণের বাংলার পাতায় নিয়মিত লিখছেন তার জীবনের কথা। কাটাঘুড়ির মতো কিছুটা আনমনা সেসব কথা, হয়তো কিছুটা অভিমানিও। কিছুটা রৌদ্রের মতো, খানিকটা উজ্জ্বল হাসির মতো।

আমার মা ও বাবা

আমাদের সময়ে, আমার বাবামার সময়ে জন্মদিন, ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি এগুলো ঘটা করে পালন করার চল ছিলনা একদমই। তখনকার সিনেমায় দেখা যেতো সাদা জামা জুতা মোজা পরে জন্মদিনের কেক কেটে কলা চানাচুর খাচ্ছে সমাজের উচ্চবিত্তের মানুষ গুলো। সেগুলো ছবিতেই মানানসই ছিলো। কিন্তু আমরা সবাই আমাদের আসল জন্মদিন, দাদা-দাদীমার বিয়ের তারিখ, বাবা-মার বিয়ের তারিখ সব জানতাম, এবং অবশ্যই আমার ডায়েরিতে তা লেখা ছিল। খুব যখন ছোট ছিলাম তখন এগুলো পালন করিনি কিন্তু একটু যখন বড় হচ্ছিলাম তখন নিজের উদ্যোগেই পালন করা শুরু করলাম। তখন কেক ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে কিন্তু ফিরনী-পায়েস এবং সদ্য মধ্যবিত্তের নাস্তার টেবিলে যুক্ত হওয়া অমূল্য নুডলস অর্ধেক করে কাটা সাগর কলা নিমকি একমুঠো চানাচুর দিয়েই জন্মদিন সাজিয়েছি। পয়লা পয়লা আম্মা রাগ করলেও পরে নিজেই আমাদের সাহায্য করতেন। দেখা গেল বান্ধবীদের নিয়ে জন্মদিন পালন করে তাদের বিদায় দেব, আম্মা পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলছেন যাচ্ছো কোথায়, আমি পোলাও রেঁধেছি , খেয়ে যাও! এভাবেই ধীরে ধীরে পরবর্তীতে পোলাও-কোর্মা সহ জন্মদিন ফিক্সড হয়ে গেলো। আব্বা আম্মার বিবাহবার্ষিকী ও পালন করা শুরু করলাম। কি যে আনন্দ লাগতো, বলে বোঝাতে পারবো না।

আব্বা খুব জমিয়ে বিয়ের গল্প করতেন। আব্বা আম্মার বিয়ের কার্ড হাতে নিয়ে বা চোখের সামনে রেখে তা কল্পনায় জীবন্ত করে ভাবতাম। খুবই গর্ব বোধ করতাম বাবামার বিয়ের কার্ড আছে এবং এখনো তা হাতে আছে বলে! আব্বা যখন গল্প করতেন আম্মা লজ্জায় লাল হতেন। আম্মা যত লাল হতেন আব্বা গল্প আরোও লম্বা করতেন। এক সময় আম্মার কপট কটাক্ষে আব্বা থামতেন। আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম। তারপর নিজেরাই যখন মাঝবয়সী হলাম তখন নিয়মিতই আব্বা আম্মার বিবাহ বার্ষিকী পালন করতাম। আব্বা খুব খুশি হতেন। বলে কয়েই খুশি হতেন। বলতেন আজ আমার আব্বা বেঁচে থাকলে হয়তো এইদিনে এমন আদরটাই পেতাম। একটু আবেগাপ্লুতও হয়ে পড়তেন।আমি ধন্য হয়ে ভাবতাম আব্বা আম্মার পঞ্চাশতম বার্ষিকীতে খুব ঘটা করবো। আব্বা আম্মাকে চমকে দেবো! পরিবারের সবার সঙ্গে খুব শলাপরামর্শ হচ্ছে, এই ডিসেম্বর গেলেই জানুয়ারি তে আব্বা আম্মার পঞ্চাশতম বিবাহ বার্ষিকী। কিন্তু ভুলে গেছিলাম যে আসমানে যতক্ষন কোন ব্যাপারে ফয়সালা হয়না ততক্ষণ জমিনে তা ঘটেনা! অক্টোবর ২০০৯ এ আমার কন্যা ফারিয়ার বিয়ে হলো। আব্বা একদম ভাইবোন বন্ধুরা যেমন বিয়েতে খাটাখাটুনি করে তেমন করে কাজ করছিলেন।

ডালা কুলা সাজানো, রঙ্গিন কাগজ কেটে দেয়া, মিষ্টির হাড়ি রাঙ্গিয়ে দেয়া এবং বিয়ের সাড়ে চারশত কার্ডে নিমিন্ত্রতদের নাম লেখা সব করলেন খুব উৎসাহ নিয়ে। বিয়ের পর নতুন নাতজামাইকে দাওয়াত করে খাওয়ালেন। নভেম্বর মাস, আমি মঞ্চানুষ্ঠান নিয়ে এ শহর ও শহর করে ঘুরছি। আম্মা বলেছেন আব্বার জ্বর, কাজের চাপে আমার আর আব্বাকে দেখতে যাওয়া হয়নি। তারপর ডিসেম্বর ২৬ তারিখ ভোরে আম্মা ফোন দিলেন ইমার্জেন্সি! এর পর এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল আইসিইউ সিসিইউ দৌড়াচ্ছি। ডঃ বললেন কে আছেন আসেন. কিছু সত্য এবং শক্ত কথা জানাই! কে আর আছে! আমি গিয়ে দাঁড়ালাম শক্ত হয়ে বললাম বলেন। ডঃ বললেন তাঁর কথা! আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। বাবা হাসপাতালে। আমার অনেক আগে থেকে নেয়া অনুষ্ঠান। জীবনসঙ্গী বললেন তুমি কি পারবে? জীবনে বিপদ বা কষ্ট একা আসেনা। ঠিক ওই মুহুর্তেই বাসা বদলাচ্ছিলাম। ঘরদোর সব তছনছ। আমার বাসায় আব্বা আম্মার রুমে আব্বার খাট খুলছিলো আর শুনছিলাম আব্বা ও খুলে খুলে যাচ্ছেন! কি ভয়ানক অনুভূতি। বাবার হাতে লাগানো টবে মিষ্টিকুমড়ার গাছে দুটি মিষ্টিকুমড়া ধরেছে। তা ছিড়ে নিয়ে মনে হল বাবাকেই ছিড়ে নিলাম। গাছ রেখে যাচ্ছি, পানি দেবে কে!কি ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে পার হচ্ছিলাম, কিন্তু পারছিলাম! মানুষ অনেক কিছু এবং সবকিছুই পারে। ওই অবস্থাতেই মঞ্চে গাইছিলাম আমার সোনার ময়নাপাখী, মনের অজান্তে দর্শকের কাছে বাবার জন্য দোয়া চাইলাম। গান গেয়ে আমি গেলাম মায়ের কাছে তাঁর বাসায়। সেখানে আম্মা তাঁর প্রিয়তমর জন্য অপেক্ষা করছেন কে নাকি আশ্বাস দিয়েছে বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। আমি বাসায় গিয়ে দেখি আম্মা ঘরদোর পরিষ্কার করে বিছানার চাদর পাল্টিয়ে রান্না করছেন। আমি প্রমাদ গুনি, আবার আশায় বুক বাঁধি।আম্মা বলেন ফোন করে জামাইকে জিজ্ঞেস কর কি খাবে আমি তাকে ফোন দেই, তিনি হাসপাতালে, আব্বার কাছে। তিনি ফোন ধরেই কাঁদতে থাকেন, বলেন, তুমি কেন ফোন করেছো? তুমি কি কিছু টের পেয়েছো? আমি নির্বাক উনি নিজেকে সামলে আমাকে বললেন তুমি এখন একজন ছেলে সন্তানের মত দায়িত্ব পালন কর, আম্মাকে সামলাও। আম্মাকে একটু খাওয়াও ততক্ষণে আমরা আব্বাকে নিয়ে আসতেছি। আমি নিজেকে শক্ত করে আম্মার পাশে বসলাম। আম্মা ভাত বাড়ছেন। আমি বললাম আম্মা আপনি আমাদের মা, সারাজীবন আপনার ছায়াতলে বড় হলাম, কোন দুর্যোগে আপনিই আমাদের সামলাবেন তাই না? আম্মা বললেন তোমার আববা নাই তাইনা? আমি বললাম না তা নয়, আম্মা বললেন মাগো তোমার অভিনয় হচ্ছে না, কখনোই হয়না, আজও হয়নাই, আমি বুঝে গেছি সব। আব্বা এলেন বারডেমের সাদা চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে। সৌম্যদর্শন স্মিতহাস্যে! বাবার বুক ছুঁয়ে দেখি তখনো গরম। আম্মা আব্বাকে দেখেই সালাম দিয়ে বললেন কি, আইজো তুমি আমার আগে সালাম দিতে পারোনি, আর মাত্র কয়দিন পর আমাদের পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী, আর মাত্র কয়টা দিন, তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলা? আমরা কানবো কি, স্তব্ধ হয়ে গেলাম দলবদ্ধ ভাবে! খুব সহজ সরল হাসিকান্না বিজড়িত পরিবার এতো স্তব্ধ কখনো হয়নি! সারাজীবন এই বিয়ে বার্ষীকিতে আপত্তি জানিয়ে পঞ্চাশতম বিয়ে বার্ষীকির বাইশ দিন আগে আব্বা স্বার্থপরের মত একলা কোথাও চলে যাওয়ার ব্যাপারটা আম্মা আজও মানতে পারেন না। আর আমি? আমার অনুভূতি আমি স্বয়ং আল্লাহতাআলাকে জানাবো ইনশাআল্লাহ। যদি তার দেখা পাই।

ছবি: লেখক

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199