এ মাসের শব্দ এনেস্থিসিয়া

কনকচাঁপা

কণ্ঠশিল্পী ও লেখক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 22 Oct 2020

925 বার পড়া হয়েছে

Shoes

শিল্পী কনকচাঁপা এবার গানের পাশাপাশি প্রাণের বাংলার পাতায় নিয়মিত লিখছেন তার জীবনের কথা। কাটাঘুড়ির মতো কিছুটা আনমনা সেসব কথা, হয়তো কিছুটা অভিমানিও। কিছুটা রৌদ্রের মতো, খানিকটা উজ্জ্বল হাসির মতো।

জীবন, সংসার, স্বজন, সন্তান, গান সব কিছু মিলিয়ে আনন্দিত অথচ পর্যুদস্ত আমরা দু'জন। কোথাও বসবার সময় নেই দু'দন্ড।কিন্তু একটা অস্বস্তি খচখচ করছে ক'দিন ধরে। আমার রেকর্ডিং, মঞ্চানুষ্ঠান, সব কিছুই আমার জীবন সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে। হয়তো ব্যাপারটা এমন যেনো উনার সঙ্গেই আমি সেঁটে থেকে কাজ করি,এটাকে আন্ডারে,ছত্রছায়ায় এমনও বলা যায়না। আমাদের দ ‘জনের পারস্পরিক এই ব্যাপারটার জন্য উপযুক্ত শব্দ আমি তখনও পাইনি এখনো না।আমি রেকর্ডিং বুথে গাইছি,উনি প্যানেলের কাঁচের ভেতর এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছেন যাতে আমরা দু’জন দু’জনকেই দেখতে পাই।মিউজিক ডিরেক্টর ভুল কিছু ধরার আগেই উনি ইশারা করেন। আমি মিউজিক ডিরেক্টরকে কিছু বলার আগে উনার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করি। এ যেন ভাবের নয় অনুভবের আদান-প্রদান। আমার মাথার উপর বটবৃক্ষ হয়ে নয়, আমার উপস্থিতিতে আর একটি উপস্থিতি হয়ে উনি বাস করেন। নিন্দুকেরা অনেক কথা বলে, বউয়ের পেছনে ঘোরে, স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেয়না,এইসব বাজে কথা। অথচ তারা একবার ও ভাবেনা বা ভাবেনি এই মানুষটার ও জীবন আছে,আছে বিখ্যাত হওয়ার আশা, আছে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন। তিনি অবশ্যই প্রথম সারির একজন সুরকার অথচ আমার জন্য তিনি তাঁর ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছেন। সে কথা কারো মাথায়ই আসেনি।

আসেনি কারণ তাদের নামই নিন্দুক, ব্যাকবাইটার।এইসব ফালতু ব্যাকবাইটার দের আমি থোড়াই কেয়ার করি।ওদের করুণা করার ইচ্ছাও আমার নাই যাইহোক যা বলছিলাম ... যে লোকটা একাধারে বাচ্চাদের স্কুল, পড়াশোনা, বাজার, বিল, মেহমানদারি, আমার হরেক রকম কাজ বাদেও নিজের কাজ নিয়ে কর্মচঞ্চল দিন কাটান তিনি ইদানীং প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বুকে পেটে অসম্ভব ব্যথা।পেটে গ্যাস জমে যাচ্ছে।ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন। ওই ব্যথা নিয়েই তিনি আমার রেকর্ডিং এ যাচ্ছেন কিন্তু রেকর্ডিং বুথে হঠাৎ আমি চোখে চোখ রাখতে গিয়ে উনাকে পাচ্ছিলাম না! এভাবে যেন কিছুই হয়না! উনাকে সামনে না দেখলে আমার গান থেমে যায়,হয়তো জীবনও।সত্যি সত্যিই উনি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। গ্যাসের ট্যাবলেট খেয়ে খেয়ে প্রায় মাস ছয়েক কেটে গেলো কিন্তু এভাবে কতদিন! অনেক ডাক্তার দেখানোর পরে জানা গেলো উনার গলব্লাডারে পাথর হয়েছে। তখন ল্যাপ্রোস্কোপি সিস্টেম চালু হয়েছে। হয়তোবা আরও আগেই, কিন্তু আমরা তখনই জানলাম। এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে শেষে ঠিক হলো তৎকালীন নামকরা শল্যচিকিৎসক মাহবুব সাহেব ল্যাপ্রোস্কোপি করবেন, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে। কিন্তু কথা হলো এনেস্থিসিয়া কে করবে! উনার অপারেশন এর চাইতে এনেস্থিসিয়ার ভয় বেশি করে পেয়ে বসলো।এই গবেষণা ওই গবেষণা, কি একটা অবস্থা। এনেস্থিসিয়া করবেন নামকরা ডক্টর সর্দার নাঈম সাহেব। তাঁকে কতো প্রশ্ন করছেন উনি। সেইসব প্রশ্নের উত্তর কতো ধৈর্য ধরে দিচ্ছিলেন। আমি উনাদের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ, এমন একজন সুপার সেন্সিটিভ মানুষকে সামাল দিয়ে তার হাসিমুখে অপারেশন করা আর ছোট খাটো যুদ্ধ জয় করা একই কথা।

আমাদের সারাবাড়ি আত্মীয় পরিজন দিয়ে ভরা। সবাইকে উনি ডেকে এনেছেন। আমি একবার এনেস্থিসিয়ার বিশদ শান্তনা মূলক আলোচনা করি আবার রান্নাঘরে সালুন কষিয়ে আসি।আবার এনেস্থিসিয়া আবার সালুনে ঝোল দেই। জীবনের সব দুর্দশা, অস্থিরতা, সব রোগ ব্যাধির কষ্টকর অনুভূতি আমি হেসে উড়িয়ে দিয়ে চেষ্টা করি এবং আমার ধারণা আমি পারিও বটে।

আমাদের বেডরুমের দরোজায় আর্টপেপার এ সুন্দর করে বড় অক্ষরে লিখলাম৷ "এনেস্থিসিয়া" এমাসের পারিবারিক শব্দ!

আমার বাবা ছাড়া কেউই এই সেন্স অফ হিউমার টা বুঝলো না।কেউই নোটিশ করলো না।কিন্তু আব্বা বললেন মাগো,তুমি পারোও বটে... তুমি সব পারবে। আমি হাসলাম, খুশি হলাম, যাক আব্বা তো বুঝলেন এই স্যাটায়ার!

অপারেশন এর সময় অনেক আত্মীয় স্বজনের সাথে হাসপাতালে যথারীতি আমাদের সুকণ্ঠি গুনী শিল্পী শাকিলা জাফর আপা দেখতে গেলেন।সেইদিন এর পরের দিন হরতাল। আমাদের বাসা শান্তিনগর আর হাসপাতাল গুলশান। শাকিলা আপা তিনবেলা খাবার পাঠানোর দায়িত্ব নিলেন এবং খুব আন্তরিকতার সাথে তা পালন করলেন। আমি এ জীবনে ওনার অনেক আদর ভালোবাসা পেয়েছি। সেসবকে যদি ঋণ হিসেবে ধরি তো তা কখনও আমি শোধ করতে পারবো না।আল্লাহ ওনার মঙ্গল করুন।

যাইহোক, ওনার অপারেশন খুব সুন্দর মতো হলো। গলব্লাডার থেকে সবুজ পিত রঙের একটা সুডৌল মার্বেল বেরুলো। আব্বা বললেন সুরকারের পাথর, গানের মতই সুরেলা। আমি আর আব্বা মিলে হাসলাম। বাকি কেউ এই হাস্যরস বুঝলোই না। অপারেশন করার দুইদিন পরেই উনি শরীরে টেপ মারা অবস্থায় আমাকে গাড়ি চালিয়ে শওকত আলী ইমনের সিনেমার গানের রেকর্ডিং এ নিয়ে গেলেন। ইমন অবাক, গত পড়শু অপারেশন হলো, আজ আপনি গাড়ি চালিয়ে রেকর্ডিং এ এসেছেন তাও ঘড়ির কাঁটা ধরে! আজব আপনারা, আপনাদের দুজনকেই স্যালুট!

ছবি: লেখকের ফেইসবুক থেকে

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199