সাহসী সিদ্ধান্ত একাই নিতে হয়

কনকচাঁপা

কণ্ঠশিল্পী ও লেখক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 4 Jun 2020

650 বার পড়া হয়েছে

Shoes

শিল্পী কনকচাঁপা এবার গানের পাশাপাশি প্রাণের বাংলার পাতায় নিয়মিত লিখছেন তার জীবনের কথা। কাটাঘুড়ির মতো কিছুটা আনমনা সেসব কথা, হয়তো কিছুটা অভিমানিও। কিছুটা রৌদ্রের মতো, খানিকটা উজ্জ্বল হাসির মতো।

বাসা বদলাবো বদলাবো করতে করতেই বর্ষা বন্যায় রূপান্তরিত হলো। মহানগর প্রজেক্ট পানিতে ডুবে গেলো।খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের গাড়িটা গাড়ির গলাপানিতে ডুবে ডুবে কোনমতে পার করে একটা গ্যারাজে রাখা হলো। মইনুল ইসলাম খান সাহেবের ফুফাতো ভাই মনির ভাই সস্ত্রীক আমাদের জোর করে তাদের শান্তিনগরের বাসায় নিয়ে এলেন। সারা ঢাকা শহর বন্যায় ভেসে গেলো।মালিবাগের রাস্তায় ও হাঁটুপানি।কি একটা অবস্থা! বাসা থেকে আসার সময় দরকারী সামান্য কিছু কাপড় জামা নিয়ে এলাম।বাচ্চাদের বই খাতাও।মুনির ভাইয়ের বউ আমাদের খুব যত্ন করে রাখলো।মুনির ভাই বলছি কিন্তু আসলে তিনি সম্পর্কে আমার দেবর।খান সাহেবের হয়তো তিন চার মাসের ছোট। আমার সব দেবর ননদ সবাই আমার বড়।আর আমি একদমই তুমি বলতে পারিনা। মুনির ভাইয়ের বউ লিপিকা নাহার আমার বান্ধবীর মতো। আনন্দেই দিন কাটছে। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে আমার নিজের বাসায়।সেখানে আমি কিছু গাছ এবং দুইটি বনসাই রেখে এসেছি। একটি বনসাই আমি অনেক কষ্ট করে আমেরিকা থেকে হাতে বয়ে এনেছি।সেই বনসাইয়ের নীচে একটি মাটির চায়নিজ বুড়ো বসে! এতো অদ্ভুত বনসাইটি! আর আরেকটি বনসাই হলো বটগাছ। তাতে ঝুরি নেমেছে।ফল ধরেছে।তাদের আমি সঙ্গে নিতে চেয়েছিলাম। আমার সাহেব বললেন আমরা দু’একদিন পরেই আসবো। কিন্তু বন্যায় এমন আটকানো আটকালাম যে বারো দিন পনের দিন পার হয়ে গেলো আমার আর বাসায় যাওয়া হলো না।গাছের চিন্তায় রাতে ঘুম হয়না। একদিন স্বপ্ন দেখি আমি যেন ওই বাসায় আট নয় মাসের ফারিয়াকে ভুলে একলা রেখে এসেছি এবং হঠাৎ আমার মনে পড়ায় আমি কাঁদছি যে এতোদিন আমার বাচ্চাটা কি বেঁচে আছে! স্বপ্ন ভেঙে দেখি আমি ঘেমে নেয়ে একাকার। আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম। এতো কিছুর মধ্যেও আমার প্লেব্যাক চলছে নিয়মিত। দুইদিন পর পরই বুলবুল ভাই, আলী ভাই, আলম ভাই, শওকত আলী, ইমন সাহার গান।কিন্তু আমি মানসিক ভাবে পর্যুদস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার দুঃখ কাউকে ছুঁতে পারছিলোনা,স্বাভাবিক। দেশ ভেসে যাচ্ছে,বাজার ঘাট ভেসে যাচ্ছে আর আমি এক পাগল আছি বনসাইয়ের দুঃখ নিয়ে। আমাকে খুব ভালো করে লক্ষ্য করে লিপি বললো ভাবি চলো আমরা তোমার বাসায় যাই।রামপুরা উলন রোড থেকেই নৌকা। আমরা বাচ্চাদের রেখে উনারা দুই ভাই মানে ইসলাম সাহেব এবং মুনির ভাই আর আমি ও লিপি গেলাম বাসায়।

যা হবার তাই হয়েছে। আমার টবের গাছগুলো সহ দুটো বনসাই -ই শুকিয়ে কাঠ।সব জায়গায় কি কাঁদা যায়? সব বয়সে? সব পরিস্থিতিতে? আমি ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়লাম। বনসাই ইচ্ছে করলেই কেনা যাবে কিন্তু এটা তো আমি মেরে ফেললাম!

আমরা সেইদিনই ডিসিশন নিলাম বাসা বদলাবো। যেহেতু বাচ্চাদের স্কুল ভিকারুননিসা এবং উইলস লিটল ফ্লাওয়ার তাই শান্তিনগরই ভালো হয়।আমরা আবার মুনির ভাইয়ের বাসায় এসে সেখানে থেকেই রোজ বাসা খুঁজতে লাগলাম। এতোদিন আমাদের বাসাভাড়া ছিলো সব মিলিয়ে ছয় হাজার। কিন্তু পছন্দ সই যে বাসা পেলাম তা সার্ভিস চার্জ সহ প্রায় তেরো হাজার টাকা। তিনরুমের সাড়ে বারশো স্কয়ার ফিট এর বাসা।একদম নতুন। কেবলই তৈরি হয়েছে। রং লাগানো হচ্ছে।দুইমাসের অ্যাডভান্স দিতে হবে।আলো বাতাস আছে।বাসার সঙ্গেই লাগোয়া মসজিদ। বাড়িওয়ালা খুব ভদ্র।বাসা আমাদের পছন্দ হলো। কিন্তু এই ডিসিশন শুনে বড় কেউ একজন খুব রেগে গেলেন।গানবাজনা কি কোন পেশা! এর কি কোন স্থায়িত্ব আছে? এতো বেশি টাকার বাসা ভাড়া নিয়ে দিতে না পারলে? উনি খুবই রেগে গেলেন। আমি আমার হাজব্যান্ড কে ইশারায় চুপ থাকতে বললাম। কারণ উনি ঘাবড়ে যাচ্ছিলেন।পরে আমি উনাকে বললাম শোন, আমরা যে পয়লা পাঁচশো টাকা শেয়ার করে বাসায় থেকেছি সেটা আমাদেরই দিতে হয়েছে। আমাদের বাচ্চার সেরেলাক ফুরিয়ে গেলে বাচ্চা কাঁদলে কেউ এক কৌটা সেরেলাক কিনে দিয়েছে? আমার শাড়ির ব্লাউজ ম্যাচিং না হলে আঁচল ঢেকে টিভিতে গান গেয়েছি তা কি কেউ জানে? আমার বা আমাদের পেশার স্থায়িত্ব না থাকলে আবার টিনের বাসায় যাবো ইনশাআল্লাহ কিন্তু তখনও কি কেউ একমাসের ভাড়া দিয়ে আমাদের সাহায্য করবে! আমাদের নিজেকে নিজের শক্তি নিয়েই চলতে হবে।গান স্থায়ী পেশা না হলে না হবে।দরকারে কাপড় সেলাই করবো। গান শেখাবো।আমার সংসার আমার, আমার সংসারের দায়িত্ব ও আমার। মানুষের উপদেশ শুনবো কিন্তু চলবো নিজেদের সিদ্ধান্তে।

আমরা নৌকায় করে মহানগর প্রজেক্টের বাসা থেকে মালসামানা নিয়ে বাসা বদলিয়ে শান্তিনগরের চামেলীবাগের " পানকৌড়ি " এপার্টমেন্ট এ এলাম।সুন্দর করে বাসা গোছালাম।বাচ্চাদের স্কুল কাছে হলো। আমার রেকর্ডিং স্টুডিও গুলোও কাছে হলো। আলহামদুলিল্লাহ জীবন আমার সহজ হয়ে গেলো। জীবনের এই সত্যকথনের এই জায়গায় আমি মুনির ভাই ও লিপিকা নাহারকে এই লেখার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।ওই সময় ওই সহায়তা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা আমাদের অনেক সাহায্য করেছিলো। চারজন মানুষকে প্রায় একমাসের জন্য মেহমান বানানো সহজ কাজ নয় যত সহজ গম্ভীর উপদেশ দেয়া।তারা আমাদের খুবই আদরে আনন্দে তাদের বাসায় মেহমান নয়, আত্মীয় নয়, বন্ধু হিসেবে আগলে রেখেছিলো। এই অধ্যায়টি আমার সারাজীবন মনে রইলো।

ছবি: লেখকের ফেইসবুক থেকে

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199