তিলোত্তমা ও একজন...

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 17 May 2018

1595 বার পড়া হয়েছে

Shoes
শিলা চৌধুরী

 (কলকাতা থেকে): সালটা ২০১০....। দিনক্ষণ আর মুহূর্তগুলো প্রায় সময়েই নাড়িয়ে দিয়ে যায় চেনা অক্ষম ভেতরটাকে।সেটা জেগে থেকেও কিংবা ঘুম ভেঙে গেলে ও।তখন আমার দপ্তরের ঠিকানা সল্টলেক । থাকতাম লেক টাউনে।কখনও যেতাম পায়েচলা সাঁকোটা দিয়ে কখনো বা অটো ধরে কেষ্টপুর নেমে বৈশাখী দিয়ে । পায়ে চলা সাঁকোতে একটা ময়লা কাপড় বিছিয়ে বসে থাকতেন একজন বয়স্কা ঠাঁকুমা। সামনে কোন থেবরানো থালা থাকতো না ভিক্ষা কিংবা দয়া প্রার্থনায় ।তাই পথ চলতি মানুষেরও যে নজরে আসতো খুব বেশি মনে হতো না।অনেকে ওনাকে টপকে চলে গিয়ে ও ফিরে এসে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী দু চার পয়সা দিয়ে যেতো।অনেকে সঙ্গে থাকা বিস্কুট, রুটি ও দিতো।ঠাঁকুমা উল্টে পাল্টে খাবার গুলো দেখতেন আর আপন মনে বিড়বিড় করে কি বলতেন সেটা অনেক বার চেষ্টা করেও বুঝতে পারতাম না। আমিও মাঝে মাঝেই কিছু খাবার আলাদা করে নিয়ে যেতাম । কিন্তু সকাল বেলায় ওনাকে কমই পেতাম সাঁকোটাতে।অটোতে যাবার পথে কোনদিনও দেখতাম বাঙ্গুর আর লেকটাউনের মাঝে যেদিকে সল্টলেকের খালটা পড়ে সেদিকের কোন গাছ তলায় বসে । নয়তো দমদম পার্ক বাঙ্গুরের মাঝামাঝি কোথাও ।কিন্তু রাতে কাজ শেষে ফেরার পথে বেশির ভাগ সময়ই সাঁকোটাতে। কোনদিন তাই কিছুই দিতে পারতাম না খাবার ।পরনে যা বস্তু থাকতো তা লজ্জা ঢাকবার মতো সব সময় থাকতো না । ছেঁড়া ,ফাঁটা, তাপ্পি দেয়া।কিন্তু ওনার মুখাবয়ব দেখে সবসময়ই মনে হতো কোন এক সময়ের সম্ভ্রান্ত আর বুদ্ধিদীপ্তের একটা আলতো আঁচড় মাখানো । সেটা জানার ক্ষমতা কোনদিনও হয়নি কারণ কখনওই উনি কোন কথার জবাব দিতেন না ।কিছু জিঙ্গেস করলেই ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকতেন কিছুটা সময় তারপর মাথা নিচু করে বসে বিড়বিড় করে যেতেন আপন মনে ।হয়তো বা বিশ্ব সংসার, তার নিজের সংসার সেই কথা বলার ভাষাটাও কেড়ে নিয়েছে সেই নির্লজ্জ সংসার আর আপনজন আর ওনার অতীতের কথা এমনকি তাঁর নিজের পরিচয়, নিজেকে মনে করার ক্ষমতাটুকুও। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগতো শীতের সময়ের চেয়েও বর্ষার সময়ে।বৃষ্টিতে দেখতাম ভিঁজে কুঁকড়ে কোন গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে ধরে বসে বসে কাঁপতে। এই সময় গুলোতে উনাকে দেখেছি, কিন্তু কোনদিনও ছলছল ভেঁজা চোখে দেখিনি কখনও । কি জানি হয়তো যখন লোকের ভিড়ে থাকতেন না দিনের বেলাটায় তখন সেই চোখের জল আড়াল করতেই নির্জন ওই গাছের তলায় বসে থাকতেন কিনা।সেটা ও জানা হয়ে ওঠেনি কোনদিনও আমার । তেমনি এক ভরা বর্ষায় ঝরের সময়ে ফেরার পথে এক প্যাকেট পাউরুটি আর দুটো কলা হাতে নিয়ে অনেক খুঁজলাম । কোথাও পেলাম না ঠাকুমাকে...। পরদিন কাজে যাবার সময় মনে করে রুটি সবজি একটা বক্সে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা চলে এসে আবার একটু ভেবে বাড়ি ফিরে একটা পুরনো কাপড় সঙ্গে করে নিয়ে নিলাম ।ভেবেছিলাম বৃষ্টির কারণে হয়তো ঠাকুমার গায়ের কাপড়সহ যা সম্বল সব ভিজে গিয়েছে ।আগের দিনের বৃষ্টি তখনও হয়েই চলেছে ।সাঁকোটাতে ওঠে না পেয়ে নিচের দিকে এদিক ওদিক তাকালাম।হাত থেকে খাবার আর কাপড়ের পুটলিটা নিজের অজান্তেই ফসকে পরে গিয়েছিল কখন টেরই পাইনি।নিচের যাত্রী ছাউনিতে দেখতে পেলাম উলঙ্গ অবস্থায় শীর্ণ শরীরটা পড়ে আছে । খালি হাতেই ছাতা ফেলে দৌড়ে নিচে নেমে দেখলাম ঠাঁকুমা ওনার বিড়বিড় করে বলা জগত থেকে অনেক অনেক দূরে চলে গিয়েছেন ।আশেপাশে অনেক পথ চলতি মানুষ, গাড়ির সারি ছুটে যাচ্ছে কেউ ফিরে ও তাকাচ্ছে না....!!! শুধুমাত্র সাঁকোটাতে ঠাঁকুমার পাশে বসে থাকতো একটা সারমেয় সে ঠাঁকুমার গা ঘেঁষে শুয়ে ।আমাকে দেখে তার মাথাটা তুলে লেজখানা দু বার একটুখানি নেড়ে আবার ঠাঁকুমার গায়ের উপর মাথাটা নামিয়ে রাখলো।কিংকর্তব্যের মতো আবার ছুটলাম সাঁকোটাতে ফেলে আসা কাপড়ের পুটলি আনতে...। হোক না অনাথ মৃতের শরীর তবু ও তো উলঙ্গ. ..!! নাইবা থাকলো এই উলঙ্গ জগতের লজ্জা. ..!!!

ছবি: গুগল  

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199